আমিরুল হাছান

  ২৪ নভেম্বর, ২০২৩

মনসুর হাল্লাজ

মরমি মহারাজ

মনসুর হাল্লাজ। পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ হুসাইন ইবনে মনসুর আল হাল্লাজ। একজন ইরানি মরমি সুফি আধ্যাত্মিক বৈপ্লবিক সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি সে সময়ের সুফিবাদীদের মধ্যে ব্যতিক্রম সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন। তিনি গোপন রহস্যের কিছু শব্দ উচ্চারণ করে বিতর্কিত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে ‘আনাল হক’ (আমিই পরম সত্য)। জীবনে তিনি অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন।

মনসুর হাল্লাজের জন্ম ২৪৪ হিজরিতে, ইরানের ফারস প্রদেশে বায়জা শহরে। পারিবারিক কাজ ছিল সুতা প্রস্তুত করা। মূলত হাল্লাজ আরবি শব্দ সুতা বা কারুশিল্প প্রস্তুতকারক। শিশুকাল থেকেই মনসুর হাল্লাজ ধর্মানুরাগী ছিলেন। ১২ বছর বয়সে মনসুর হাল্লাজ কোরআনের হাফেজ হন। ছোটবেলা থেকে মনসুর হাল্লাজ সুফিদের মজলিসে যাতায়াত করতেন। মনোযোগ দিয়ে শুনতেন সুফি ব্যক্তিদের কথা।

মনসুর হাল্লাজ ১৮ বছর বয়সে তুস্তরে যান এবং সেখানকার নামকরা সুফি শাহল আল তুস্তারির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং শরিয়ত ও মারিফতের তালিম নেন। আনুমানিক দুই বছর সেখানে অবস্থান করেন। পরে বাগদাদ হয়ে বসরায় চলে যান। শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন আমর আল মক্কির। এখানেও বছর দু-এক সুফিবাদের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা নেন। ওই সময় তরুণ মনসুর হাল্লাজ সুফি ইয়াকুব আল আকতি কার্নাবাইয়ের মেয়ে উম্মুল হুসনাইনকে বিয়ে করেন। একমাত্র ছেলে আহম্মদ ইবনে হোসাইন ইবনে মনসুর।

মনসুর হাল্লাজ যখন আমর আল মক্কির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন, তখন একবার আমরের কোরআন তিলাওয়াত শুনে বলেছিলেন- আমি এর চেয়ে সুন্দর করে পড়তে পারি। আমর বেয়াদবি মনে করে মনসুরকে পরিত্যাগ করেন। আসলে মনসুর হাল্লাজ যখন যেখানে যেতেন, অল্পদিনেই গুরুর গুরুত্ব ভারত্ব বুঝে ফেলতেন, তাই তিনি অনেক দিন স্থায়ী হতে পারেননি কোথাও। অতঃপর তিনি জুনায়েদ বাগদাদির কাছে শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন। সেখানে কিছুদিন শিক্ষা নিয়ে হিজরি তৃতীয় শতাব্দীর সত্তর দশকের দিকে হেজাজে চলে যান। সেখানে কিছুদিন বসবাস করেন।

২৭০ হিজরিতে তিনি হজ করার জন্য মক্কায় যান। সেখানে প্রায় এক বছর অবস্থান করেন। নামাজের পাশাপাশি সব সময় ধ্যানরত অবস্থায় থাকতেন। এরপর মক্কা ত্যাগ করে বাগদাদে ফিরে আসেন। এখানেও বেশিদিন থাকেননি। কোনো আত্মিক খোঁজে দেশান্তরী হয়ে যেতেন প্রায় সময়। ২৮৪ হিজরিতে তিনি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের মনস্থির করেন। এশিয়ার বহু এলাকা এবং চীন-ভারতবর্ষ ভ্রমণ করেন এবং ধর্ম প্রচার করেন। এরই মধ্যে তার বহু ভক্ত তৈরি হয়। তিনি শিষ্যদের নিয়ে দুবার হজ পালন করেন। এরপর বাগদাদে চলে আসেন।

মনসুর হাল্লাজ একবার ধ্যানরত অবস্থায় এক অবর্ণনীয় জ্যোতির্ময় নুর দেখতে পান। মনসুর জিজ্ঞাসা করেন- তুমি কে? জ্যোতির্ময় উত্তর দিলেন- আনাল হক অর্থাৎ আমি পরম সত্য। হক শব্দটি আল্লাহতায়ালার ৯৯ নামের একটি নাম। এই জ্যোতির্ময়ের বাণীতে মনসুর হাল্লাজ এতটাই আবেগাপ্লুত হয়েছেন, তিনি এই প্রেমের শব্দের উচ্চারণ ভুলতে না পেরে মৃত্যু পর্যন্ত বলে গেছেন আনাল হক, মানে আমি পরম সত্য। এই কথা যখনই প্রকাশ্যে আনেন, তখন থেকেই বুজুর্গ ব্যক্তিরা তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন এবং বিতর্কিত সুফি হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকেন।

অনেক সুফি মনে করেন, ওই সময়টায় মনসুর হাল্লাজ নিজের হালতে (অবস্থা) ছিলেন না, ছিলেন তরিকতের হালতে। যেমন বায়তুশ শুকুর দরবার শরীফের গদিনশীন পীর রেজাউল হক খান বলেন, মানুষ যখন আল্লাহর অলি বা বন্ধু হতে চলে, তখন ফানাবিল্লাহ পর্যায়ে গিয়ে ইচ্ছা থাকলেও অনেক কিছুই করতে পারে না বা গোপন নিদর্শনের আয়না সুস্পষ্ট করা যায় না।

মনসুর হাল্লাজ যখন বলতে থাকেন আনাল হক আমি পরম সত্য, এই অর্থে কথাটা আল্লাহর সঙ্গে শিরক (অংশীদারত্ব) বিবেচনা করা হয়। নিজেকে এই মর্মে উচ্চারণের জন্য সেকালের কাজি এবং সুফিবিদরা তাকে মিথ্যাবাদী ইহুদি প্রতারক বলে অপবাদ দেন এবং ফেরাউনের সঙ্গে তুলনা করেন। কিন্তু মনসুর হাল্লাজের ভক্তরা বলেন, ফেরাউন আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করতে, কিন্তু মনসুর হাল্লাজ আল্লাহর জ্যোতির্ময় ধ্বনির বাণী উচ্চারণ করে গেছেন শুধু। তার এই বাণী আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করেই বলা হয়েছে। তিনি আল্লাহর প্রেমে মজ্জুব (আল্লাহর প্রতি আকর্ষিত) হয়ে গিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে মনসুর হাল্লাজ তার নামও ভুলে যেতেন।

আধ্যাত্মিক মানুষরা যখন পৃথিবীর সৃষ্টির সুন্দরের সব রহস্যের প্রেমে পড়ে যান এবং মারিফতের গভীর রহস্যের সন্ধান পান, তখন সবকিছু প্রকাশ করা শরিয়তসম্মত না।

মনসুর হাল্লাজ এ কথাও বলতেন, আমার অস্তিত্বে আল্লাহ ছাড়া কিছু নেই। আমার জামার নিচে আল্লাহ ছাড়া কিছুই নেই। আসলে এই জাতীয় কথার কারণে কাফির বা মুশরিক বলা যায় না। এ সময় এসেও মনসুরকে নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষের আলোচনা চলে। অলি-আউলিয়াদের এখানেই সার্থকতা। মনসুর হাল্লাজের নিয়তের খবর অনেকেই বুঝতে চাননি। মনসুর হাল্লাজের আকিদা ভালো ছিল বলে অনেকেই মতবাদ দেন, যেমন আবু আবদুর রহমান সুলামি বলেন, আমি মনসুর বিন আবদুল্লাহ ও শিবলী (রহ.)-কে বলতে শুনেছি- আমি ও মনসুর একই অবস্থার ছিলাম, তবে তিনি প্রকাশ করেছেন আমি গোপন করেছি। শিবলী থেকে আরো বর্ণনা আছে, হাল্লাজকে শূলে চড়ানো দেখে তিনি বলেন, আমি কি মানুষকে জানাতে তোমাকে নিষেধ করিনি?

মনসুর হাল্লাজ গদ্য-পদ্য প্রচুর লিখতেন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ আল-তাওয়াসিন, যেখানে সংক্ষিপ্তভাবে বলা আছে- আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেছিল ইবলিশ। আদম নবীকে সিজদা করতে অস্বীকার করে। এ ব্যাপারে মনসুর হাল্লাজ বলেন, যদি আল্লাহকে নাই চিনতে পারো, তাহলে অন্তত তুমি তার নিদর্শনকে তো চেনো। তার আরেক প্রসিদ্ধ বই দিওয়ানে মনসুর হাল্লাজ। তার কবিতার কিছু লাইন আজও পাঠকের মনে নাড়া দেয়- ‘আমিও এক টুকরো মনসুর হাল্লাজ/দুনিয়াকে ভেবে বলো আমার কি কাজ/আমি তো স্বপ্নে তোমার আরশের কারুকাজ দেখি/তোমার নুরের তাজ্জালিতে দুচোখ করে মাখামাখি/রাখি করুণার বাতাসে মাথা।’

বিভিন্ন কথা বিভিন্ন সময় প্রকাশ্যে আনার জন্য মনসুর হাল্লাজ কারাবাসে ছিলেন প্রায় ১২ বছর। কারাবন্দিদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল খুবই চমৎকার। অধিকাংশ কারাবাসী এবং কারারক্ষী ও দরবারের উজির-নাজিররা তার ভক্ত হয়ে যেতেন এবং ধর্মীয় অনুরাগের কথা প্রকাশ করতেন। মনসুর হাল্লাজকে ৩০৯ হিজরিতে জনসমক্ষে হত্যার নির্দেশ দেন আব্বাসীয় খলিফা আল-মুকতাদির। তার মৃত্যু মর্মান্তিক ছিল। যখন তাকে শূলে চড়ানো হয়, তখন একজন সুফি জিজ্ঞেস করেছিলেন- প্রেম কী? মনসুর হাল্লাজ প্রতি-উত্তরে বলেন, তুমি আজ, কাল ও পরশু তা নিজ চোখে দেখবে। সেদিনই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তার পরের দিন দেহাবশেষ পুড়ানো হয়, পরের দিন দেহভস্ম বাতাসে মিলিয়ে ফেলা হয়। বিখ্যাত সুফি কবি ফরিদ উদ্দিন আত্তার বলেন, এটাই প্রেম।

শূলে নিয়ে মনসুর হাল্লাজের প্রথমে যখন একটি পা কেটে ফেলা হয়, তিনি বলেন, জান্নাত সন্নিকটে দেখতে পারছি। আমার বাকি পা কাটো। সেই পাও কাটা হলো। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, আমার হাত কাটো। একটি কাটার পর আরেকটি কাটার জন্য বলেন। হাত কাটার পর রক্তক্ষরণের কারণে মুখ সাদা হয়ে যায়। দেখতে মনে হচ্ছিল তিনি ভীতু; তাই নিজের হাতকাটা বাহুর রক্ত মুখে মেখে নেন, যাতে তাকে দুর্বল মনে না হয়। তারপর তার কান কাটা হলো, নাক কাটা হলো, জিহ্বা কাটা হলো। জিহ্বা কাটার আগে হাল্লাজের শেষ কথা ছিল- স্রষ্টাকে ভালোবাসা নিজের থেকে আলাদা নয়। জেনে রেখো, এটাই সত্য। সঙ্গে সঙ্গে তার পুরো জিহ্বা কেটে ফেলা হয় এবং মাগরিবের ওয়াক্তে শিরশ্ছেদ করা হয়। শিরশ্ছেদের সময় মনসুর হাল্লাজ হাসতেছিলেন। পৃথিবীর বুকে কোনো সুফি ব্যক্তির এতটা নির্মম মৃত্যু হয়নি। আল্লাহর প্রেমে জীবন কোরবান করে গেছেন মরমি আধ্যাত্মিক সুফি ব্যক্তিত্ব মনসুর হাল্লাজ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close