আলমগীর খোরশেদ

  ১৭ নভেম্বর, ২০২৩

গ্রামীণ ঐতিহ্য

নদীতে পালের নৌকা

ইঞ্জিন নৌকা আসায় পালতোলা নৌকা হারিয়ে গেছে

সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সবুজ গ্রামবাংলায় জালের মতো ছড়িয়ে আছে নাম না-জানা অসংখ্য খাল-বিল, নদ-নদী। বর্ষায় দুকূল ছাপিয়ে ডুবিয়ে দেয় গ্রামীণ জনপদ। নদীর বুক চিরে তিরতির করে এগিয়ে যায় পালতোলা নৌকা। পাটবোঝাই করে নৌকা ছুটে গঞ্জে। হালকা সাদা কিংবা রঙিন পালে হাওয়া লেগে নৌকা ছুটত তার গন্তব্যে। বাঙালি জাতি হিসেবে নদীকেন্দ্রিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হাতছানি দিয়ে ডাকে। মহাজনী নৌকা মালামাল বোঝাই করে দূরপাল্লার হাটে যাওয়ার সেই দৃশ্য। ভাটিয়ালি গানের সুরে বাড়ির মানুষটির জন্য মন খারাপে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নৌকার ছইয়ের নিচে কর্তা ব্যক্তির বুকের বাঁপাশ যেন কেমন করে ওঠে।

পালতোলা নৌকা একটি আদিবাহন। নৌকার ওপরে হালকা সাদা রঙের কাপড় বাতাসে দেবে যেতে দেখা যায়, সেটাকেই নৌকার পাল বলে। মাস্তুল হলো নৌকায় পাল খাটাতে যে বড় খুঁটির প্রয়োজন হয়, সেটা। আর নৌকার মাঝি যে যন্ত্র ধরে নৌকা চলাচলের দিক পরিবর্তন করতে পারেন, সেটাই হলো নৌকার হাল। নৌকার দাঁড় হলো নৌকা চালানোর দণ্ড। ছোট দাঁড়কে বলে বইঠা। আর নৌকা ঠেলে চালানোর দণ্ডকে লগি বলে, যা দিয়ে নৌকাকে বেয়ে সামনের দিকে নিয়ে যায়, সেটাকে নৌকার বইঠা বলে। নৌকা যে চালান তাকে বলে মাঝি। নদীতে বাতাস যখন পড়ে যায়, তখন আর পাল কাজ করে না। তখন একজন মাঝি নদীর তীরে গিয়ে গুন টেনে নিয়ে যান। গুন টানা ছিল অনেক কষ্টের। নৌকার সঙ্গে বাঁধা লম্বা দড়ির মাথা লাঠির অগ্রভাগে বাঁধা থাকত, মাঝি তার কাঁধে দড়ি বাঁধা লাঠিটি ঠেকিয়ে নদীর পাড় ধরে হেঁটে যেতেন। উঁচু, নিচু, ঢালো, গর্ত, সমান কোনো কিছুই তাকে দমাত না। গঞ্জের হাটে ঠিক সময়ে পৌঁছাতে হবে, তাই। গুন টানা মাঝির কাঁধে বড় দাগ হয়ে যেত। নৌকার পালকে অঞ্চলভেদে বাদাম বলা হয়। মনসামঙ্গল কাব্যে বণিক চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্য তরী চৌদ্দ ডিঙা নিয়ে শুরু করে বাণিজ্য যাত্রা। সেখানেও পালতোলা নৌকার কথা উল্লেখ আছে। ক্রিট দ্বীপের মানুষ এক লাখ ত্রিশ হাজার বছর আগে নৌকার ব্যবহার করত বলে জানা যায়। বর্তমানে পলি পড়তে পড়তে নদীতে জেগেছে চর। খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার থেকে তিন হাজার সালে জলযানের আনাগোনা ছিল বলে ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করেছেন।

নতুন বউ শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে যেতে পালতোলা নৌকার আবদার করত।

পাঁচ হাজার বছর আগে ভূমধ্যসাগরে বহু দাঁড়বিশিষ্ট নৌকা চোখে পড়ত। দাঁড় টানার কাজটি তখন কৃতদাস দ্বারা করানো হতো। দাঁড় টানার পাশাপাশি পাল টানানো হলে নৌকার গতি বেড়ে যায়।

নৌকার অংশগুলো হলো- খোল, পাটা, ছই বা ছাউনি, হাল, দাঁড়, পাল, পালের দড়ি, মাস্তুল। নৌকার খোলকে জলনিরোধক করার জন্য আলকাতরা ব্যবহার করা হয়।

বারো ভূঁইয়াদের শ্রেষ্ঠ বীর ঈশা খাঁ ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা থেকে নওয়াবদের বিতাড়িত করেন রণতরীর মাধ্যমে। বিক্রমপুরের কাছে নৌযুদ্ধে মুঘল সেনাপতি মানসিংহের নৌবহরকে পরাস্ত করে ঈশা খাঁ তার বিজয় পান। তখনকার সময়ে পাল তৈরি হতো পুরোনো কাপড় দিয়ে। বড় তালি দেওয়া। চরাঞ্চলে গবাদি পশু পারাপারে নৌকার ব্যবহার হতো।

যান্ত্রিক সভ্যতায় পুরোনো ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। নদী মরে গেছে। ইঞ্জিন নৌকা আসায় পালতোলা নৌকা হারিয়ে গেছে কালের আবর্তে। স্মৃতির ক্যানভাসে পালতোলা নৌকা আজও জ্বলজ্বল করে ষাটের দশকে জন্ম নেওয়া মধ্যবয়সিদের মনে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close