নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৮ জুন, ২০২৪

বেপরোয়া কিশোর গ্যাং এক বছরে ২৫ হত্যা

* সারা দেশে ২৩৭ সদস্য * বেশির ভাগ ১৮ বছরের বেশি বয়সি * সবচেয়ে বেশি ঢাকায়, ১২৭ * হোতারা আড়ালে

দিন দিন বেড়েই চলেছে কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধের পরিধি। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখল, নারীদের উত্ত্যক্ত করা- দেশের যেকোনো এলাকায় এখন এ ধরনের অপরাধ ঘটলে কিশোর গ্যাংয়ের নাম আসছে। অথচ এক যুগ আগেও পাড়া-মহল্লাকেন্দ্রিক অপরাধের ঘটনায় নাম আসত কোনো না কোনো সন্ত্রাসী বাহিনীর। এখন সে জায়গা ‘দখল’ করেছে কথিত কিশোর গ্যাং। যদিও এসব বাহিনীর সদস্যের বেশির ভাগই ১৮ বছরের বেশি বয়সি।

পুলিশ জানায়, গত এক বছরে সারা দেশে ২৫টি হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিল কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, অপরাধীরা আইনের ফাঁকে বের হয়ে গেলেও হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় বেড়েই চলছে দাপট।

জানা গেছে, গত মাসে ময়মনসিংহে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৬ বছরের এক কিশোরকে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। একইভাবে চলতি মাসের শুরুতে সিলেটে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে প্রাণ হারায় আলী নিশো নামে এক কিশোর। হত্যাকাণ্ড ছাড়াও বিভিন্ন সময় ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জমি দখলসহ বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত কিশোর গ্যাংয়ের নিপীড়নের শিকার সাধারণ মানুষ। এসব বিষয় নিয়ে উঠতি বয়সি তরুণদের মাঝে দেখা দিয়েছে আতঙ্কের ছাপ।

অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের ব্যবহার করে খুন ও মাদক চোরাকারবারিসহ বিভিন্ন অপরাধমূক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে স্বার্থান্বেষী মহল। তাদের জন্য আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কিশোর গ্যাংকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আইনের আওতায় আনতে হবে অপরাধের পেছনের কারিগরদের।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেছেন, কিশোররা যেন ‘গ্যাং’ সংস্কৃতিতে না ঝুঁকে পড়ে। তাদের এই পথ থেকে ফেরাতে হবে তাদের মাধ্যমেই। অল্প বয়সিদের মধ্যেই অপরাধবোধ জাগাতে হবে। এতে নিজেরা নিজেদের শুধরাবে, সমাজে সংঘবদ্ধ অপরাধপ্রবণতা কমে যাবে। শিক্ষার্থীরা সচেতন হলে শিশু-কিশোর অপরাধ প্রশমনে তারাও এগিয়ে আসতে পারে। ছাত্রছাত্রীরা জেগে উঠলে একই সঙ্গে সমাজও মাদকমুক্ত হবে।

আর ঢাকা মহানগর মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলছেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। কোনো কিশোর অপরাধীকে কাস্টডিতে নেওয়ার পর যদি কারো নাম বলে যে আমি, ওমুক এর প্ররোচণায় এ কাজ করেছি, তখনই পেছনে যাওয়া যায়। কোনো প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া আইনসঙ্গত নয়। এটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

সূূত্র জানায়, গত দেড় বছরে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ৬৪টি বেড়ে এখন ২৩৭টি। এদের ২ হাজার ৩৭২ জন গ্যাং সদস্যের অনেকের বিরুদ্ধে নানা অপরাধে ৭৮০ মামলা রয়েছে। তাই প্রশাসনের সঙ্গে জাতির বৃহৎ স্বার্থে এখনই সমাজ সংস্কারক ও জনপ্রতিনিধিরা এগিয়ে না এলে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি সামলানো কষ্টকর হবে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।

জানা গেছে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করা সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা গত এপ্রিলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কথিত কিশোর গ্যাংদের তৎপরতা নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এখন সারা দেশে ২৩৭টির মতো ‘কিশোর গ্যাং’ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকা শহরে, ১২৭টি। এসব গ্যাংয়ের (অপরাধী দল) সদস্য ১ হাজার ৩৮২ জন। ঢাকার পর চট্টগ্রামে রয়েছে ৫৭টি। এসব দলের সঙ্গে জড়িত ৩১৬ জন।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঢাকা বা চট্টগ্রাম নয়, গাজীপুর ও খুলনা মহানগর এলাকায়ও বিভিন্ন নামে কিশোর গ্যাং চক্র গড়ে উঠছে; যারা খুন ও ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে। নিজেদের মধ্যেও সংঘর্ষ-মারামারিতে জড়াচ্ছে এসব গ্যাংয়ের সদস্য। জেলা শহরগুলোয়ও কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বাড়ছে। যেমন গত ১৮ এপ্রিল নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলায় কথিত কিশোর গ্যাং ‘এফ টেন’-এর সদস্যরা নিজেরাই বিরোধে জড়ায়। বৈশাখী মেলায় দোকান বসানো নিয়ে নিজেদের বিরোধ থেকে ১৮ বছর বয়সি এক তরুণকে (গ্যাংয়ের সদস্য) ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

এর আগে ২৯ জানুয়ারি নোয়াখালী সদর উপজেলায় কথিত কিশোর গ্যাংয়ের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ২০ বছর বয়সি এক তরুণ খুন হন। মূলত এলাকায় কোন গ্যাংয়ের প্রভাব বেশি থাকবে- এ নিয়ে দুই পক্ষে বিরোধ দেখা দেয়। স্থানীয় পুলিশের কর্মকর্তারা তখন এমনটি বলেছিলেন।

নোয়াখালীর ওই দুটি ঘটনার পর কথিত কিশোর গ্যাংকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ এসেছিল স্থানীয় কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে। তখন পুলিশ বলেছিল, তদন্তে ইন্ধনদাতাদের নাম এলে গ্রেপ্তার করা হবে। কিন্তু দুটি খুনের ঘটনায় গ্যাংয়ের কয়েকজন সদস্য ছাড়া রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী (ইন্ধনদাতা হিসেবে নাম আসা) কাউকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি।

কিশোর গ্যাং সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেওয়া বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা গ্রেপ্তার হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে গডফাদাররা (পৃষ্ঠপোষকেরা)। কিশোর গ্যাংয়ের মদদদাতা ও আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের তথা নেপথ্যের শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close