কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি

  ০১ মার্চ, ২০২৪

বাঁধ নির্মাণে বন ধ্বংস

* সংস্কার কাজের মান নিয়েও উঠেছে নানা প্রশ্ন * বনের জমিতে দিঘি কেটে মাছের ঘের * ভেস্তে গেছে সরকারের মূল পরিকল্পনা

পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় চলছে বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজ। প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা। কিন্তু হয়েছে তার উল্টো। বাঁধ নির্মাণে ধ্বংস করা হয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। সংস্কার কাজের মান নিয়েও উঠেছে নানা প্রশ্ন। বেড়িবাঁধ নির্মাণে অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব থেকে সমুদ্র উপকূলকে রক্ষায় নির্মিত বাঁধে ব্যবহার করা হয়েছে সংরক্ষিত বনের বালুমিশ্রিত মাটি। উজাড় করা হয়েছে প্রায় শত একর বনভূমি। বনের জমিতে দিঘি কেটে বানানো হয়েছে মাছের ঘের। বন ধ্বংস বন্ধে স্থানীয়রা প্রতিবাদ জানালেও উল্টো তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। ২০১৭ সালের ১৯ জুলাই কুয়াকাটায় ৪৮নং পোল্ডারের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প, ফেজ-১ প্রকল্পের আওতায়, প্যাকেজ-২-এর কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি। পরবর্তী সময়ে কয়েক দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার কথা রয়েছে। শুরুতে এ কাজ চিনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিআইসিও (সিকো) শুরু করলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারেনি। এরপর স্থানীয় বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সাব-ঠিকাদার নিয়োগ করে সিকো। তারপরই শুরু হয় নানা অনিয়ম, ওঠে বিস্তর অভিযোগ। স্থানীয়রা বলছেন, উপকূলের রক্ষাকবচ বেড়িবাঁধ নির্মাণে স্থানীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা মাটির পরিবর্তে বালু ব্যবহার করেছে। এমনকি বালুমিশ্রিত মাটি আনা হয়েছে সংরক্ষিত বনের ভেতর থেকে। যার ফলে হুমকির মুখে পড়েছে মানুষের জানমাল রক্ষাকবচ সংরক্ষিত বনাঞ্চল।

বন থেকে হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। বনের সেই স্থানে তৈরি করা হয়েছে বড় বড় দিঘি। আর বনের মালিকানা দাবিতে এসব দিঘিতে মাছ চাষ করছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ফলে সমুদ্রবেষ্টিত উপকূলের সবুজ বেষ্টনী দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির মুখে পড়েছে। ভেস্তে গেছে সরকারের মূল পরিকল্পনা। এসব অনিয়মে জড়িত রয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও বন বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা, এমন দাবি ভুক্তভোগীদের। বেড়িবাঁধের পাশের বসবাসকারীদের অভিযোগের শেষ নেই।

স্থানীয় ইউপি সদস্য দুলাল সিকদার বলেন, বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজে বালুমিশ্রিত মাটি ব্যবহার করা হয়েছে। গঙ্গামতি সংরক্ষিত বনের গাছ ভেকু দিয়ে উপড়ে ফেলে মাটি আনা হয়েছে। বন উজাড় করে মাটি এনে ব্যবহার করা হয়েছে বেড়িবাঁধে। এ বিষয় তারা বিভিন্ন সময় বন বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসনকে অবহিত করেছেন। তারা দেখছি, দেখব বলে আশ্বস্ত করলেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। তার অভিযোগ বন উজাড় করার পেছনে বন বিভাগের কর্মকর্তারাই দায়ী।

বনের এক উপকারভোগী বলেন, বাঁধ সংস্কার করতে গিয়ে শত শত একর বনভূমি উজাড় করা হয়েছে। বন বিভাগ শুধু কয়েকটি মামলা করেই তাদের দায়িত্ববোধ শেষ করেছে। স্থানীয় প্রভাবশালী সাব ঠিকাদাররা বন ধ্বংস করে মাটি এনে বেড়িবাঁধে ব্যবহার করেছে। হাজার কোটি টাকার বনভূমি উজাড় করা হয়েছে দাবি তার। এ বিষয়ে প্রতিবাদ করলে উল্টো তাদের নামে মামলা করা হয়েছে। হুমকি দেওয়া হয়েছে প্রাণনাশের।

কুয়াকাটা পৌরসভার প্যানেল মেয়র (২) শহীদ দেওয়ান বলেন, সাব ঠিকাদাররা বেড়িবাঁধে সংস্কারে ব্যাপক অনিয়ম করেছে। মাটির চেয়ে বালুর ব্যবহার বেশি করা হয়েছে। রাতের আঁধারে বাঁধের ঢাল থেকে বালু উঠিয়ে বাঁধের মধ্য দিয়ে ওপরে শুধু মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। একপর্যায়ে স্থানীয়রা কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন এবং পৌর মেয়রের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীর হস্তক্ষেপে আবার কাজ শুরু করা হয়েছে। এছাড়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই অভিযোগ করেছেন, বন উজাড় করার কারণে তারা ঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন। মাটির পরিবর্তে বাঁধে বেশিরভাগই বালু ব্যবহার করায় বাঁধের স্থায়িত্ব নিয়ে তারা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

অভিযোগ অস্বীকার করে পটুয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগের মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম বলেন, তারা বন রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বন ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনিক সহযোগিতা না পাওয়ায় বন রক্ষায় তারা কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেননি। তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানোর পর তারা কয়েক দফা পরিদর্শন করেছেন।

পাউবো কলাপাড়া সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব হোসেন বলেন, উপকূলীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণে বেশকিছু অভিযোগ ছিল। সেগুলো সমাধান করেই কাজ চলমান রয়েছে। তবে বাঁধে ২৫ ভাগ বালু ব্যবহার করার বিধান রয়েছে। বাঁধে বনের মাটি ব্যবহারের বিষয় তিনি জানান, বাঁধে মাটি কিনে ব্যবহার করা হয়েছে। সাব ঠিকাদাররা কোথা থেকে মাটি এনেছেন, এটা তাদের জানার কথা নয় বলেও জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডের এ কর্মকর্তা।

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বন রক্ষার জন্য বন বিভাগকে আরো সতর্ক থাকতে হবে। তার কাছে এমন অভিযোগ এলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে কয়েকটি ড্যাম্প ট্রাক ও ভেকু জব্দ করা হয়েছে। বনের মাটি কাটার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেওয়া হয়েছে। তবে বনের জমির মালিকানার প্রশ্নে তিনি জানান, ‘কীভাবে তারা বনের জমির মালিক হয়েছেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close