reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১৯ মে, ২০২৪

হানিফ ওয়াহিদের হাসির গল্প

মেহমান

কুমিল্লা, চাঁদপুরের কিছু অঞ্চলের মানুষ বেড়াতে খুবই পছন্দ করে। অনেক দূরসম্পর্কের আত্মীয়বাড়িও তারা ছেলেমেয়ে নিয়ে অনায়াসে চলে যায়। আত্মীয়তার সম্পর্ককে তারা বেশ গুরুত্ব দেয়। মেহমানদারিতেও তারা বেশ সচেতন।

আমার শাশুড়ির বাপের বাড়ি চাঁদপুর। কখনো যাওয়া হয়নি। শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রায়ই তাগাদা আসে সেখান বেড়াতে যাওয়ার জন্য। সময়ের অভাবে যাওয়া হয় না। একবার ঈদে শ্বশুরবাড়ি গেছি, সবাই চেপে ধরল, চল চাঁদপুর থেকে ঘুরে আসি। সবার অনুরোধে ঢেকি গিলতে হলো। আমার শালা-শালি বেজায় খুশি হলো, যখন আমি রাজি হলাম।

এক দিন সকালবেলা নারায়ণগঞ্জ থেকে লঞ্চে রওনা হলাম চাঁদপুরের উদ্দেশে। আমার স্ত্রী গেল না, শালা-শালি ভরসা। সেখানে আমার মামাশ্বশুর থাকেন। চাঁদপুর স্টেশনে নেমে ইলিশ মাছের আড়তে গেলাম। এত ইলিশ মাছ বাপের জন্মেও দেখিনি। অরিজিনাল পদ্মার ইলিশ দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না, অনেকগুলো মাছ কিনে ফেললাম।

মামাশ্বশুরের বাড়ি চাঁদপুর শহর থেকে একটু ভেতরে, গ্রামের দিকে। রাস্তাঘাট খারাপ। গাড়ি গ্রামে ঢুকে না, অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হলো। রাস্তাঘাট ভাঙা, হেঁটে যেতে অসুবিধা। এক লোকের সঙ্গে রাস্তায় পরিচয় হলো, সে আমাদের এগিয়ে নিতে এসেছে। আমি খুশি হলাম, সঙ্গে মাছের ব্যাগ, নানা ফলফলাদির পোঁটলা থাকায় আমাদের বেগ পেতে হচ্ছিল।

আমাকে পেয়ে মামাশ্বশুর বেজায় খুশি হলেন। তিনি বললেন, জামাই, ইলিশ মাছ বাদ, তোমাকে আমার পুকুরের টাটকা মাছ খাওয়াব। মুখে লেগে থাকবে। তক্ষুণি লোকজন পাঠালেন তাদের পুকুর থেকে মাছ ধরে আনার জন্য।

তিনি একজন বড় কৃষক। কোনো কিছুই কিনে খেতে হয় না। আমাদের যথেষ্ট আপ্যায়ন করলেন। রাতে কুলিপিঠা বানানো হলো, এমন মজাদার পিঠা জীবনে খেয়েছি কি না মনে করতে পারলাম না। সকালবেলা মামাশ্বশুর ঘুরে ঘুরে গ্রাম দেখালেন। তাদের থেতখামার দেখলাম। সঙ্গে আছেন সেই লোক যিনি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিলেন।

কাজ থাকায় পরের দিন-ই আমাকে ঢাকায় ফিরতে হবে, তাদের শত অনুরোধ সত্ত্বেও আরেকটি দিন থাকা গেল না। আমার শালাশালি দু-এক দিন থাকার জন্য রয়ে গেল। মামাশ্বশুর সেই লোককে আমার সঙ্গে দিলেন পথ এগিয়ে দেওয়ার জন্য। ফিরতি পথে ধন্যবাদ দিলাম এবং বললাম সম্ভব হলে আমাদের বাসায় বেড়িয়ে যেতে।

ছয় মাস পর, একটা কাজে বেরোনোর সময় দেখি সেই লোক তার বউ আর দুই বাচ্চা নিয়ে আমাদের বাসায় উপস্থিত। এসেই ভাইজান বলে আমাকে এমন করে জড়িয়ে ধরল মনে হলো আমি তার মায়ের পেটের আপন খালাত ভাই!

শত হলেও শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়, কাজ ফেলে ছুটলাম বাজার করতে। রাতে খাওয়ার টেবিলে খাচ্ছি আর গল্প করছি, সেই লোক কথা প্রসঙ্গে বলল, অনেক দিন হয় সে খাসির মাংস খায়নি। পরের দিন বাজারে দৌড়ে গেলাম খাসির মাংস আনতে। শ্বশুরবাড়ির লোক বলে কথা!

সারা দিন ব্যস্ত ছিলাম, রাতে বাসায় ফিরে দেখি সেই মেহমান তখনো আছে। একসঙ্গে খেতে বসেছি, সে আবার জানাল, তার অনেক দিনের শখ, হাঁসের মাংস দিয়ে চিতই পিঠা খাবে। কি আর করা! পরের দিন সকালে বাজারে গিয়ে দুটো হাঁস কিনে আনলাম।

রাতে বাসায় ফিরে দেখি আমার সেই মেহমান হাঁসের মাংস দিয়ে আরাম করে চিতই পিঠা খাচ্ছে। আমি ফ্রেশ হয়ে খেতে বসেছি, লক্ষ করলাম, গিন্নি নাক-মুখ কুঁচকে আছে। আমি বললাম, ঘটনা কী?

গিন্নি তেজ দেখিয়ে বলল, হাঁসের লোম বাছতে গিয়ে আমি শেষ। আঙুল ব্যথা করছে। বাজারের নাম শুনলে পারো তো অজ্ঞান হয়ে যাও, নিজের পক্ষের আত্মীয় হলে ঠিকই বাজার করো, আমার পক্ষের আত্মীয় হলে আজকে কখনো বাজারে যেতে না। অন্য কাউকে পাঠাতে বাজার করতে।

আমি অবাক হয়ে বললাম, লে হালুয়া! আমার পক্ষের আত্মীয় মানে? তোমার পক্ষের আত্মীয় বলেই এত খাতির করছি। গিন্নি আকাশ থেকে পড়ল, আমার পক্ষের আত্মীয়! তোমাকে দেখে জড়িয়ে ধরল বলে আমি ভাবলাম তোমাদের ঘনিষ্ঠ কোনো আত্মীয় হবে!

আমি হেসে বললাম, তোমার মামাবাড়ির আত্মীয় আর তুমি চিন না? হাউ ফানি জরিনার নানি! গিন্নি এবার সত্যি অবাক হলো, আমার মামাবাড়ির আত্মীয় আর আমি চিনি না! এ তো আমার মামাবাড়ির আত্মীয় নয়। সে তক্ষুণি তার মামাবাড়ি ফোন দিল। তার মামা জানাল, সেই লোক তাদের কোনো আত্মীয় নয়, তবে মাঝে মাঝে ফাইফরমাশ খাটে। তাদের গ্রামের লোক। সে লোককে তার মামা কিছু টাকা দিয়ে পাঠিয়েছিল আমাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য। এ পর্যন্তই ব্যাপার।

গিন্নি তিন দিন ধরে গাধার মতো খেটে এদের সেবা করছে আমার আত্মীয় ভেবে। আর আমি কামকাজ ফেলে আমার সবচেয়ে অপছন্দের কাজ বাজার করছি শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় ভেবে! কিন্তু এরা কীভাবে আমাদের বাসায় এলো?

গিন্নি গিয়ে সেই লোকের কাছে যা শুনল, তা শুনে তার অজ্ঞান হওয়ার জোগাড়! সেই লোক তাকে জানাল, আমার শালার কাছে থেকে সে ঠিকানা জেনে রেখেছিল। আমি ফিরতি পথে তাকে ধন্যবাদ দিয়েছি এবং তাকে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসার দাওয়াত দিয়েছি, নইলে তার ঠেকা পড়ে নাই কামকাজ ফেলে এখানে এসে পড়ে থাকার! অতি ভদ্রলোক বিধায় তিনি সেই দাওয়াত কবুল না করে পারেন নাই!

আমি স্ত্রীর ভয়ে দুদিন বাসায় ফিরলাম না। প্রতিজ্ঞা করলাম, মরে গেলেও জীবনে কাউকে ধন্যবাদ দেব না। কখনোই না!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close