আবুল কালাম আজাদের হাসির গল্প
কবিতার কোচিং টিচার
বইমেলা চত্বরে একাকি এক জায়গায় খুব উদাস দৃষ্টি মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এক লোক।
লোকটার গায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি। পরনে রংচটা জিনস। পায়ে চটি-স্যান্ডেল। বাম কাঁদে একটা চটের ব্যাগ। ডান কাঁধে একটি চাদর ভাঁজ করা। লোকটার চোখে কালো রঙের মোটা ফ্রেমের চশমা।
দেখে অনুমান করা যায়, লোকটা কবি, মানে কবিতা লেখে।
একজন সাংবাদিক গিয়ে দাঁড়াল তার পাশে। লোকটা তা টের পেল না। সাংবাদিক তার সামনে গিয়ে পটাপট কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল। সে তা ভ্রুক্ষেপ করল না। কবিরা সবকিছু ভ্রুক্ষেপ করে না। সাংবাদিক বলল, আপনি কি কবি?
তখন কবির দৃষ্টি ফিরল। বলল, না। আমি কবি না।
- কিন্তু আপনি যেভাবে আকাশ দেখছিলেন...।
- মেঘগুলো পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাচ্ছে, দৌড়ে যাচ্ছে, নাচছে...।
- আপনি তো কবির মতোই কথা বলছেন। তাহলে কবি না বলছেন কেন?
- আমি কবি না। আমি কবিদের শিক্ষক। মানে কবিতা লেখা শেখাই।
- ও আপনি সাহিত্যের অধ্যাপক।
- না না, আমি অধ্যাপক না।
- তাহলে কবিদের শিক্ষক কীভাবে?
- আমার একটা কোচিং সেন্টার আছে, সেখানে কবিতা লেখার ওপর কোচিং দিই।
- কবিতা লেখার ওপর কোচিং! নাম কী আপনার কোচিং সেন্টারের?
- এসো কবিতা লিখি।
- বাহ! সুন্দর নাম। আপনার কোচিং সেন্টারের কোনো স্লোগান আছে?
- অবশ্যই আছে-
‘যখন মাথায় জমে ভাব
তখন আমরা সবাই কবিতার বাপ।’
- বাহ বাহ বাহ! অনেক সুন্দর স্লোগান। আপনার কবিতার কোচিং সেন্টারটা কোথায়?
- ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে।
- প্রাণকেন্দ্রটা কোথায়?
- সাংবাদিকতা করেন, কিছুই বোঝেন না। যে যেখানে তার ব্যবসা খুলে বসে সেটাই তার কাছে প্রাণকেন্দ্র। আপনার কি আরো প্যাঁচাল আছে? আমি আকাশ দেখছিলাম।
- আপনার কবিতার কোচিং সেন্টারে ভর্তি হতে কত টাকা লাগে? মাসিক বেতন কত?
- ভর্তি ফি ৯৯৯ আর মাসিক বেতন ৪৯৯।
- ৯৯৯ কেন?
- আমি মনে করি, ১০০০ টাকার একটা নোট দিতে অনেকের সমস্যা হবে তাই ৯৯৯ করেছি, তেমনি ৫০০ টাকার একটা নোট দিতেও তাদের কষ্ট হবে, তাই ৪৯৯ করেছি।
- আপনার বুদ্ধিটা চমৎকার। অনেক কথা বললাম। আপনার কাছ থেকে আর বেশি সময় নেব না। আচ্ছা, আপনার কাছে যারা কোচিং করে তাদের কবিতার বই কি এসেছে এবার বইমেলায়?
- আসেনি আবার? সাত দিন কোচিং নেওয়ার পরই বই বের করার জন্য সবাই পাগল হয়ে ওঠে। একজন শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌতুক এনে কবিতার বই প্রকাশ করেছে। আরেকজন জমি বিক্রি করে...। আরেকজন বাড়ির ঘর বিক্রি করে বই করেছে। বউ-বাচ্চা এখন খোলা আকাশের নিচে থাকে। আরেকজন...।
- আরেকজন কী?
- বউয়ের গহনা চুরি করে বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে...। বউ তাকে তালাক দিয়ে চলে গেছে। দেখেছেন কবিতা প্রেম কী জিনিস। বউয়ের চেয়ে কবিতার বইয়ের দরকার বেশি।
- আপনার কোনো বই এসেছে?
- নাহ! আমি শুধু ৪/৫টা বইয়ের কভার তৈরি করেছি। সেই কভার ফেসবুকে দিই। সবাই লেখে অভিনন্দন, শুভেচ্ছা।
- কভার দিচ্ছেন, কেউ কি জানতে চায় না বইগুলো কোন স্টলে...?
- আরে ধুর! ৪ লাইনের কবিতা কেউ পড়তে চায় না। অভিনন্দন আর শুভেচ্ছা লিখে দায় সারে। এরা করবে বইয়ের খোঁজ! আমার কোচিংয়ের ছাত্ররা বই বের করেছে। স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্যের সঙ্গে দেখা হলে অভিনন্দন বা শুভেচ্ছা জানায়। ভুলেও একজন আরেকজনের বইয়ের কাছে যায় না। এই যে দেখেন দেখেন...।
হঠাৎ কবিতার কোচিং টিচার সাংবাদিককে কাছে টেনে নিয়ে বলল- ওই যে দুই টুকরা মেঘ দেখতেছেন। মনে হচ্ছে ওরা পরস্পরের হাত ধরে নাচতেছে, তাই না? কি অপূর্ব দৃশ্য!
সাংবাদিক বলল, আমি তো এ রকম কিছু দেখতে পাচ্ছি না। দুই খণ্ড মেঘ বেশ দূরে। হাত ধরবে কেমনে?
- দেখতে পারতেছেন না? এই চোখ নিয়া তুই একজন কবিতার শিক্ষকের সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলতেছোস? তুই আমার সামনে থেকে যাবি, নাকি দৌড়ানি দিমু?
হঠাৎ কবিতার শিক্ষকের অগ্নিমূর্তি। চোখ লাল। হাত মুষ্ঠিবদ্ধ। তুই-তোকারি করে কথা বলছে। সাংবাদিক ভয় পেয়ে গেল। এখানে থাকা আর নিরাপদ না। সে ঝেরে দৌড়। কবিতার কোচিং টিচার আবার আকাশ দেখতে লাগল।
"