আতিকুর রহমান, তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ)

  ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর

ধ্বংসের মুখে টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য

হাওরের এমন বেহাল ও অব্যবস্থাপনায় ক্ষোভ স্থানীয় বাসিন্দাদের * মাইকের উচ্চ শব্দে পর্যটকদের অনিয়ন্ত্রিত বিচরণে হাওর হারাচ্ছে জৌলুশ

সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে ধ্বংসের মুখে টাঙ্গুয়ার হাওরের জীব-বৈচিত্র্য। একসময় দেশীয় প্রজাতির মাছে ভরপুর থাকলেও বর্তমানে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে হাওর এলাকার মৎস্য ভাণ্ডার।

জানা যায়, শ্যালো মেশিন দিয়ে বিলের তলা শুকিয়ে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে মাছ শিকার, কারেন্ট জাল, কিরণ মালা চাঁই, চায়না দুয়ারী দিয়ে মাছ শিকার করায় ধ্বংস হচ্ছে কালি বাউশ, রাণী, বাছা, শিং, মাগুর, পাবদা, রাণীপুটি, শৌল, গজার, বোয়াল, খলিশা, টাকিসহ শতাধিক প্রজাতির মাছ। আগে টাঙ্গুয়ার হাওরে বিরল প্রজাতির ফিস পেলিসাস ঈগল দেখতে পাওয়া গেলেও এখন আর তা চোখে পড়ে না।

হাওর পাড়ের জেলে শেরাফুল মিয়া বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে আগে নৌকা চালিয়ে গেলেই মাছ নৌকায় লাফিয়ে উঠত। কিন্তু এখন জাল দিয়েও মাছ পাওয়া যায় না।

জানা যায়, ছোট বড় ১০৯টি বিল, ৮৮টি গ্রাম ও ১২ হাজার ৬৫৫ দশমিক ১৪ হেক্টর ভূমি নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরের অবস্থান। এ হাওরে পানির নিচে থাকা উদ্ভিদ প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছের বাসস্থান এবং খাদ্যের জোগান দেয়। কিন্তু টাঙ্গুয়ার হাওরটি বর্তমানে পরিবেশগতভাবে সংকটে পড়েছে। কর্তৃপক্ষের সঠিক নজরদারীর অভাবে অবাধে কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রাণ হিজল-করচের বাগান। উচ্চ শব্দের মাইক আর নৌকা নিয়ে পর্যটকদের অনিয়ন্ত্রিত বিচরণে হাওর হারাচ্ছে তার নিজস্ব জৌলুশ। পর্যটকদের ফেলে যাওয়া ময়ালা আর প্লাস্টিকে সয়লাব টাঙ্গুয়ার হাওরের চারপাশ। হাওররের এমন বেহাল ও অব্যবস্থাপনায় ক্ষোভ জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

১৯৯৯ সালে সরকার ইকোলজিকাল ক্রিটিকাল এরিয়া (ইসিএ) বা বিপন্ন প্রতিবেশ এলাকা এবং ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি টাঙ্গুয়ার হাওরকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রামসার সাইট হিসেবে ঘোষণা করে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ায় দিন দিন কমে যাচ্ছে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা। মাছ, গাছ আর পাখি না থাকলে হারিয়ে যাবে টাঙ্গুয়ার হাওরের জীব-বৈচিত্র।

খোঁজ নিয়ে আরো জানা যায়, ১২ ভোল্ট ডিসি ব্যাটারির সঙ্গে আল্ট্রাসনিক ইনভার্টার সংযোগ করে ৬৮ হাজার থেকে কয়েক কোটি ওয়াট বিদ্যুতের শক তৈরি করে। এই মেশিন দিয়ে ৫ ফুট থেকে ৪০ ফুট বৃত্তের মধ্যে কয়েক সেকেন্ড আঘাত করে এবং একই পরিমাণ জায়গায় থাকা জীবন্ত ছোট বড় সব ধরনের মাছসহ জলজ প্রাণীকে অজ্ঞান করে ফেলে তা শিকার করা হচ্ছে।

জানা যায়, ধর্মপাশা, মধ্যনগর ও তাহিরপুর উপজেলার প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে টাঙ্গুয়ার হাওর। টাঙ্গুয়ায় হেমন্তে ২৪ হাজার ২৫ একর জমিতে পানি থাকে। ২০০ প্রজাতির মাছ, ১২ প্রজাতির ব্যাঙ এবং ১৫০ প্রজাতির সরীসৃপের সমন্বয়ে জীববৈচিত্র্য গড়ে উঠেছিল এই হাওর। তবে বর্তমানে ৫৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে। শীতকালে টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় ২৫০ প্রজাতির অতিথি পাখির বিচরণ ঘটত এক সময়।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. মৃত্যুঞ্জয় কুণ্ড বলেন, মাছের প্রজননের সময় হাওরে ইঞ্জিন নৌকার শব্দে মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হয়। এতে মাছের বংশ বৃদ্ধি হয় না।

টাঙ্গুয়ার হাওরে কর্মরত ইউএসএআইডি ইকোসিস্টেমস অ্যাক্টিভিটির কর্মকর্তা ইয়াহিয়া সাজ্জাদ বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের ট্যুরিজম ব্যবসা জীববৈচিত্র্যের ও প্রতিবেশের জন্য হুমকি স্বরূপ।

গবেষক ও লেখক পাভেল পার্থ বলেন, হাওরের পর্যটকদের জন্য আমাদের কোনো নীতিমালা নাই।

সম্প্রতি টাঙ্গুয়ার হাওরে আগত পর্যটক ও পর্যটকবাহী নৌযানের নিরাপত্তায় ১০ দফা নির্দেশনা জারি করেছিল সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন। কিন্তু তা কেউই মানছে না।

টাঙ্গুয়ার হাওর ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে আসা পর্যটকদের নিয়ন্ত্রণ করতে প্রচলিত আইনকানুনের আলোকে গাইডলাইন অচিরেই বাস্তবায়িত হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close