টাঙ্গাইল প্রতিনিধি

  ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

টাঙ্গাইলের চমচমে জিআই স্বীকৃতি

‘চমচম, টমটম ও শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি’। স্থানীয় লোক প্রবাদে উঠে এসেছে টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর চমচমের কথা। কেবল নামেই নয়, আকৃতি, স্বাদ ও গন্ধে এই মিষ্টি সেরাদের সেরা। সম্প্রতি মিষ্টির রাজা পোড়াবাড়ীর চমচম পেয়েছে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতি। আর এই প্রাপ্তিতে আনন্দিত টাঙ্গাইলের ব্যবসায়ী ও চমচমপ্রেমীরা। টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর চমচমের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আনুমানিক ২০০ বছরের পুরোনো ইতিহাস।

টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ভৌগোলিক নির্দেশক ইউনিট ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন ২০১৩ অনুযায়ী সম্প্রতি টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর চমচমকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর চমচম আরো প্রসারিত হবে বলে আশা মিষ্টি ব্যবসায়ীদের। চমচম তৈরির কাজে জড়িত কারিগররাও খুশি।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক কায়ছারুল ইসলাম জানান, তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই করে টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর চমচমকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ শিল্পকে আরো সমৃদ্ধ করতে কারিগরদের উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মণ্ডপরিকল্পনা রয়েছে। এটা টাঙ্গাইলবাসীর জন্য অত্যন্ত আনন্দের খবর। সামনের দিনগুলোয় চমচমের গুণগতমান অক্ষুণ্ণ রেখে কীভাবে দেশে-বিদেশে সবার কাছে টাঙ্গাইলের চমচম একটি প্রসিদ্ধ খাদ্য হিসেবে তুলে ধরতে নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। সংশ্লিষ্টদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ী চমচমের পথ চলা আরো সমৃদ্ধ হবে।

জানা গেছে, দশরথ গৌড় নামে এক ভাগ্যান্বেষী ব্রিটিশ আমলে আসাম থেকে টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর তীরবর্তী সদর উপজেলার পোড়াবাড়ীতে আসেন। তিনিই গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে প্রথমে চমচম তৈরি শুরু করেন। তার মিষ্টি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। ধীরে ধীরে পোড়াবাড়ীতে প্রায় অর্ধশত চমচম তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে।

এখন পোড়াবাড়ীর চমচমের সেই জৌলুস না থাকলেও খ্যাতি কমেনি। এখনো টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনী বাজরের মিষ্টির দোকানগুলো ধরে আছে চমচম তৈরির ঐতিহ্য। এখানকার প্রতিটি মিষ্টির দোকানেই নির্ভেজাল পোড়াবাড়ীর চমচম পাওয়া যায়। পাঁচআনি বাজারে প্রায় অর্ধশত মিষ্টির দোকান রয়েছে।

চমচমের গড়ন অনেকটা লম্বাটে। হালকা আঁচে ভেজে তৈরি বলে রংটা গাঢ় বাদামি। বাইরে একটু শক্ত হলেও এর ভেতরের অংশ লালচে গোলাপি নরম রসালো ও কড়া মিষ্টিতে পূর্ণ। ঘন রস আর টাটকা ছানার গন্ধমাখা এ মিষ্টির স্বাদ অতুলনীয়।

সুস্বাদু চমচম তৈরির মূল উপাদান দুধ, চিনি, পানি, সামান্য ময়দা ও এলাচ দানা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, চমচম সব বয়সীর পছন্দের উপাদেয় মিষ্টান্ন। বিয়ের অনুষ্ঠান, পূজাপার্বন, জন্মদিনসহ সব পারিবারিক অনুষ্ঠানে পোড়াবাড়ীর চমচমের তুলনা হয় না। এছাড়া পরীক্ষায় ফলাফল, চাকরির প্রমোশন, নির্বাচনের বিজয়, নতুন চাকরিসহ নানা সুসংবাদের বার্তা দিতে চমচমের শরণাপন্ন হতে হয়। শ্বশুরবাড়ি বা আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়ার সময় এই চমচম দিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় এখনো সর্বমহলে প্রচলিত প্রথা।

টাঙ্গাইলের বেশির ভাগ দোকানের মালিক নিজেরাই চমচম তৈরি করেন। আবার তাদের কাজের সহায়তার জন্য রয়েছে একাধিক সহযোগী। যমুনার চরাঞ্চলের গাভীর দুধ দিয়েই মূলত পোড়াবাড়ীর চমচম তৈরি হয়। এই মিষ্টি তৈরিতে কোনো কেমিক্যাল ব্যবহার হয় না।

পোড়াবাড়ীর চমচমের কদর দেশজোড়া। ইদানীং বিদেশগামীরাও সঙ্গে নিয়ে যান পোড়াবাড়ীর এই মিষ্টান্ন। টাঙ্গাইলের বড় বড় মিষ্টির দোকানে প্রতিদিন গড়ে ৫ থেকে ১০ মণ চমচম তৈরি হয়। ঘোষ ও পাল সম্প্রদায় বংশানুক্রমিকভাবে নিয়োজিত আছেন এই পেশায়। তবে অন্যান্য ধর্মবর্ণের লোকজনও এই মিষ্টান্ন তৈরিতে নিয়োজিত হয়েছেন। চমচমের পাশাপাশি রসগোল্লা, আমৃত্তি, জিলাপি, সন্দেশ, দানাদার, দই, খির, রসমালাই, কালোজাম, খাজা, বাতাসা, কদমা, নই টানা ইত্যাদি মিষ্টিও তৈরি হয়। যা ভোজন রসিকদের মন জয় করে আসছে।

বর্তমানে চমচম বিক্রি হচ্ছে মান ভেদে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা লোকজন ছুটে আসেন মিষ্টির দোকানগুলোয় ঐতিহ্যবাহী চমচমের স্বাদ নিতে।

টাঙ্গাইল জেলা রেস্তোরাঁ ও মিষ্টি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি স্বপন ঘোষ বলেন, আমার বাবা ১৯৩৯ সাল থেকে মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। সেখান থেকে আমিও মিষ্টির ব্যবসা করছি। আমার পরের জেনারেশনে আমার ছেলেও আছে। মূলত এ পোড়াবাড়ীর চমচমের উৎপত্তি হয়েছে সেই বিটিশ আমল থেকে।

চমচমের জনপ্রিয়তা এবং স্বাদ ও মান বিষয়ে স্বপন ঘোষ বলেন, চমচম সুস্বাদু হওয়ার একটা কারণ হচ্ছে- চরাঞ্চল থেকে যেসব গাভীর দুধ আসে, সেগুলো অনেক ভালো। আর জলেরও একটা বিষয় আছে। দুধ, জল ও কারিগরের সমন্বয়েই এ মিষ্টির স্বাদ হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close