শাহেদ শুভ্র হোসেন
রবিনের ব্যাট
রবিনের আজ কিছুই ভালো লাগছে না। তার ভীষণ মন খারাপ। সে ঠিক করেছে স্কুল থেকে আজ আর বাড়ি ফিরবে না। সারা দিন এখানে-সেখানে ঘুরে খালামণির বাসায় যাবে। আজ ক্লাসে অঙ্ক পরীক্ষার খাতা দিয়েছে। খাতার ওপরে নম্বরের জায়গায় লাল কালিতে দুটো বড় বড় শূন্য দেখে চারপাশটাও যেন তার শূন্য হয়ে গেছে। যদিও এ শূন্যপ্রাপ্তি তার কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবার চিন্তা হচ্ছে কারণ সে বাড়িতে কথা দিয়েছে আর কোনো দিন পরীক্ষায় শূন্য পাবে না। অঙ্ক স্যারটা এত কঠিন প্রশ্ন করবে কে জানে! জানলে কী আর মিছেমিছি কথা দিতে যায় মাকে!
এই খাতা মায়ের হাতে পড়লে আর কোনোভাবেই রক্ষা নেই। লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে যাবে তাকে নিয়ে বাসার ভেতর। তার ওপর বাবা বাসায় নেই। অফিসের কী যেন এক কাজে রংপুর গেছেন। বাবার অফিসের বসের ওপর খুব রাগ হলো রবিনের। এই সময়টাতেই বাবাকে পাঠাতে হলো রংপুরে। তাকে রক্ষা করার একমাত্র ভরসার জায়গাটাও এখন নেই। সে চোখ বন্ধ করে দেখতে পেল মায়ের হাতে কাঁচা কঞ্চি। না বাবা, ঘরে ফিরে এমন আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার দরকার নেই। সারা দিন এদিক-ওদিকে ঘুরে সন্ধ্যায় খালামণির বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলেই হবে। খালামণিই এখন শেষ ভরসা।
অঙ্ক স্যারটাও যেন কেমন, এতক্ষণে বোধহয় ফোন করে বিশাল এক জোড়া শূন্য প্রাপ্তির খবরটা মাকে জানিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে তার। স্যার যখন সবার খাতার নম্বরগুলো পড়ে পড়ে শোনাচ্ছিলেন, তখন তার নম্বর শুনে ক্লাসে হাসির রোল পড়ে গিয়েছিল। যেন এমন শূন্য এই প্রথম কেউ পেল পৃথিবীতে। শূন্যের মাহাত্ম্য তোরা কী বুঝবি বোকার দল! এ কথা বলে মনে মনে সান্ত¡না খুঁজছিল রবিন। আইনস্টাইন কি অঙ্কে ফেল করেনি? এডিসন কি অঙ্কে ফেল করেনি? আর আমাদের রবীন্দ্রনাথ সে তো স্কুলের নাম শুনলেই পালিয়ে বেড়াত। যতসব!
স্কুল ছুটির পর নদীর পাড়ে গিয়ে একটা গাছের গোড়ায় বসে পড়ল রবিন। পেট ক্ষুধায় চিন চিন করছিল। দুটো ডালপুরি কিনে এনে খেয়েদেয়ে গাছের গোড়ায় কখন যেন ঘুমিয়ে গিয়েছিল, রবিন বুঝতেই পারেনি। ঘুম ভাঙল রাজু ও রতনের ডাকাডাকিতে।
কীরে মাঠে যাবি না? প্র্যাকটিস করবি না? কাল ফাইনাল খেলা। ফিজিক্যাল স্যার তোকে খুঁজছে। বলল, রাজু।
রবিন ভুলেই গিয়েছিল ফাইনাল খেলার কথা। অঙ্কের খাতাটাই যত নষ্টের গোড়া। তাই তো! কাল তো ফাইনাল ম্যাচ। ওদের স্কুল আগামীকাল ফাইনালে খেলবে জেলা স্টেডিয়ামে। হাত দিয়ে দ্রুত দুচোখ কচলাতে কচলাতেই রবিন ওদের সঙ্গে দৌড় দিল স্কুলমাঠের দিকে। প্র্যাকটিস শেষ করে সন্ধ্যায় রবিন ফিরল খালামণির বাসায়। খালামণি যেন আগে থেকেই জানতেন রবিন আসবে। খাবার-দাবার রেডি করেই বসেছিলেন রবিনের অপেক্ষায়।
রবিন খাবারের আয়োজন দেখে বলেই ফেলল, খালামণি তুমি কি জানতে নাকি আমি আসব?
জানব না আবার! তোর মা ফোন করে সব বলে দিয়েছে। এও বলে দিয়েছে, গাধাটাকে যেন ঘরে ঢুকতে না দিই। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন খালামণি।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসল রবিন। খবরটা মা জেনে গেছেন! কী আর করা। পেট ভরে খেয়েদেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।
ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন দেখল রবিন। ফাইনাল ম্যাচ চলছে। ব্যাট করতে নেমে শূন্য রানে আউট হয়ে গেছে সে। সরাসরি বোল্ড আউট। মাঠে খেলা দেখতে যাওয়া ওদের ক্লাসের সবাই হাসাহাসি করছে। অঙ্ক স্যারকেও দেখতে পেল রবিন। স্যার যেন ওকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলছে অঙ্ক পরীক্ষাতেও গাধাটা শূন্য পেল গতকাল আর খেলার মাঠেও আজ শূন্য রান। কিচ্ছু হবে না গাধাটাকে দিয়ে!
স্বপ্নে রবিন আরো একটা মুখ দেখল। মায়ের মুখ। ভীষণ রাগে চোখ দুটো লালবর্ণ ধারণ করেছে। মা হুঙ্কার দিয়ে কটমট করে ওর দিকে তাকিয়ে বলছে র-বি-ন এদিকে আয়! মার হাতে কাঁচা কঞ্চি।
ধড়মড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে রবিন দেখল খালামণি বিছানার পাশে এসে ওকে ডাকছে। খালামণি তাড়া দিয়ে বলল, কয়টা বাজে দেখেছিস। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। আজ না তোর ফাইনাল খেলা!
রবিন রেডি হয়ে সোজা স্কুল থেকে স্টেডিয়ামে চলে গেল দলের সবার সঙ্গে। আজ ওদের ফাইনাল ম্যাচ। আজ জিতলেই ওরা চ্যাম্পিয়ন। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ এর আগে কোনো দিন পায়নি ওদের স্কুলের কেউ। এজন্যই হয়তো মাঠ ভর্তি হয়ে গেছে ওদের স্কুলের শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের দিয়ে। বিপরীত টিম পরপর তিনবারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। শক্ত প্রতিপক্ষ।
মাঠে খালামণিও এসেছেন। রবিনের সঙ্গে দেখা করে মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে গেছেন।
নির্ধারিত সময়ে খেলা শুরু ও শেষ হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য ফলাফল। হারতে হারতেও চার উইকেটে জিতে গেল রবিনদের স্কুল টিম। আনন্দ আর উত্তেজনায় মাঠের মধ্যে ঢুকে পড়েছে রবিনের স্কুলের ছেলেরা। শিক্ষকরাও বাদ গেলেন না। ওরা চ্যাম্পিয়ন। কে আর আটকাবে ওদের!
মাঠের মধ্যে একটি ছেলেকে ঘাড়ে করে নিয়ে দৌড়াচ্ছে সবাই। সেই ছেলেটিই আজকের জয়ের নায়ক। হেরে যাওয়া ম্যাচ অসাধারণ ব্যাটিং করে জিতিয়ে দিয়েছে ছেলেটি। সে ম্যান অব দ্য ম্যাচ তো হবেই সেই সঙ্গে ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট। ছেলেটির নাম রবিন।
খালামণি গ্যালারিতে হই-হুল্লোড় আর চেঁচামেচির মধ্যেই রবিনের মাকে ফোন করলেন।
হ্যালো আপা, তাড়াতাড়ি টিভি চালু কর। তোর রবিনকে টিভিতে দেখাচ্ছে। ও সেঞ্চুরি করেছে। এর আগে কেউ স্কুল টুর্নামেন্টে এত কম বলে সেঞ্চুরি করেনি।
মাঠের মধ্যে সবাই রবিনকে ঘাড়ে তুলে নাচছে। তুই টিভি চালু কর আপা। ফোনের ওপাশ থেকে তেমন কিছুই শোনা গেল না। যেন নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে চারপাশে। ফোনকল কেটে দিতে দিতে খালামণি শুধু শুনতে পেলেন কান্না জড়ানো রবিনের মার কণ্ঠ ‘আমার রবিন সেঞ্চুরি করেছে’।
"