আশরাফুল আলম শিমুল

  ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা

পৃথিবীর শুরু থেকে কত হাজারো ঘটনা নিয়ে যুদ্ধ ও জীবন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ভাষার জন্য জীবন দেওয়ার ইতিহাস একমাত্র আমাদেরই। এজন্যই ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের গর্ব ও অহংকার। আজ জানব অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ঘটে যাওয়া সেই গল্প। সে গল্পের দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। প্রাণের বিনিময়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার এক অনন্য গল্প। বাঙালির ইতিহাসের এক হার না মানা গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের গল্প।

১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যায় ভারত আর পাকিস্তান। ভারতের সঙ্গে দেশভাগের পর ভাষা, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থান ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও শুধু ধর্মীয় সংখ্যা গরিষ্ঠতার ওপর ভিত্তি করে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান দুটি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়। সংস্কৃতি, ভাষা, শিক্ষা, আচার-আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে অমিল থাকার কারণে দুই প্রদেশের জনগণকে একই কাতারে কল্পনা করা যাচ্ছিল না। জনসংখ্যার দিক দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও সিভিল সার্ভিস, মিলিটারি ও গুরুত্বপূর্ণ সব রাষ্ট্রীয় পদে তাদের আধিপত্য বেশি ছিল। ক্রমে তারা নিজেদের শাসনকর্তা ও বাঙালিদের প্রজা ভাবতে শুরু করলেন।

এত কিছু করেও ক্ষ্যান্ত হননি তারা। নবগঠিত রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তারা উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করতে থাকে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৭-এর ডিসেম্বর মাসে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। এভাবে চলতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যকার শীতল যুদ্ধ।

পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন আত্মকেন্দ্রিক সিদ্ধান্তের কারণে আবারও সোচ্চার হয়ে উঠে বাঙালি। ফলে ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে পুনরায় মিছিল করা হয়। মিছিল করার অপরাধে গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী গোলাম মাহাবুব, অলি আহাদ, শওকত আলী, সামসুল হকসহ অনেকে।

২১ মার্চ, ১৯৪৮ সাল। ঢাকার রেসকোর্স ময়দান তৎকালীন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ দৃঢ় ভাষায় ঘোষণা করেন ‘উর্দু, এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ এমন ঘোষণায় আবারও সোচ্চার হয়ে উঠে সমগ্র বাংলা। মায়ের মুখের ভাষা ছেড়ে অন্য ভাষায় কথা বলার প্রশ্নই আসে না। এভাবে অতিবাহিত হয় আরো ৪ বছর।

২৭ জানুয়ারি, ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের নবনিযুক্ত গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকায় এসে পুনরায় ঘোষণা দেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ এই ঘোষণা শোনার পর আবার গর্জে উঠে বাঙালি জাতি, প্রতিবাদে জ্বলে উঠে সারা বাংলা। ২১ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে হরতালের ডাক দেওয়া হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সাল। সকাল হতে না হতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জড়ো হতে লাগল ছাত্রজনতা। পাকিস্তান সরকার ওইদিন ঢাকায় ১৪৪ ধারা ঘোষণা করে।

একসময় সমবেত ছাত্রজনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং গাজীউল হকের নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সবাই মিছিল নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মিছিল যখন ঢাকা মেডিকেলের কাছাকাছি আসে, তখন শুরু হয় পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলি। গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রফিক, জব্বার, সালাম ও বরকত। বুলেটের আঘাতে রফিকের মাথা ফেটে মগজ বের হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে জব্বার ও বরকত ওইদিন রাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আহত অবস্থায় ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে মারা যান সালাম। এই ২১ ফেব্রুয়ারি বর্তমানে প্রতি বছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পৃথিবীর সব দেশে একযোগে পালিত হয়। ১৭ নভেম্বর, ১৯৯৯ সালে ইউনোসকো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা’ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং ২০০০ সাল থেকে সারা বিশ্ব এই দিবসটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন শুরু করেন।

অমর একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে বলা শুরু করলে শেষ করা সম্ভব নয়। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের শেকড়, আমাদের অহংকার। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন, যা বাস্তবায়িত হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় আর্জনের মাধ্যমে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close