সুরঞ্জন মজুমদার

  ০২ ডিসেম্বর, ২০২৩

শীতকাল ও আমাদের কুলসুমরা

বাতাস ধীরে ধীরে নয়, খুব দ্রুততার সহিত ঠাণ্ডা থেকে ঠাণ্ডাতর হচ্ছে। ঋতু পরিবর্তনের জানান দিচ্ছে প্রতিক্ষণে। বার্তা দিচ্ছে তৈরি হতে, শীতকে উপভোগ করতে। ঋতুচক্রে শরতের বিদায় হলো মা দুর্গার বিসর্জনের সঙ্গেই। আগমনীর গান গেয়ে এলো হেমন্ত। আবহাওয়া জানান দিচ্ছে শীত আসছে, খুব দ্রুতই আসছে এই নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশে। শহুরে বিলাসী জীবনে শীত মানেই এক অন্যরকম আমেজ। ভ্রমণ, আড্ডা, ফ্যাস্টিভ্যাল, কনসার্ট কত না আয়োজন। এক স্বর্গীয় ছোঁয়ার আভাস নিয়ে আসে শীতকাল।

শীতকাল এখনো অনেকটাই দেরি। সবে সাজসজ্জার শুরু। তবে এবার একটু ভিন্ন মাত্রায় সেজে উঠছে ঋতুরাজের মুকুটহীন রানিরূপে।

কুলসুম বেগমের শনের ঘরের বেড়ার ফাঁকগুলো দিয়ে সূর্যকিরণের প্রবেশ যেন নতুন দিনের মঙ্গলবার্তা নিয়ে আসে। ইদানীং সেই কিরণ সংকীর্ণ থেকে প্রবল সংকীর্ণের পথে। হয়তো অচিরেই সেই বেড়ার ফাঁকটুকু দিয়ে সূর্যের সেই মঙ্গলবার্তার বাহক কিরণরশ্মি না এসে ইটভাটার ধোঁয়ার মতো স্বতেজে শীতল কুয়াশায় হীমের প্রবেশ ঘটবে। ঘড়ির কাঁটা এগারোর দাগ পেরোলেই আমাদের সকাল শুরু, শীতের সকাল। এই অবেলার সকালে সকালে মাংস-খিচুড়ি অথবা অলসতার জেরে অনলাইনে খাবার অর্ডার করে তা দিয়েই সকালের নাশতা নামক ভূনিভোজ চলে। কখনো অলিগলিতে বেড়ে ওঠা ছোট্ট ঝুপরির দোকানের গরম পিঠা; গ্রামীণ পদ্ধতি বিলীন শহুরে কায়দায় তৈরি, যা প্রায়ই আমাদের শহুরে লোকজনের সকালের নাশতা মেন্যুতে থাকে। দুপুরে চায়নিজ, রাতে নাম না জানা খাদ্য আইটেমে পূর্ণ সঙ্গে কফি আড্ডা, মাঝরাতে পার্টি, একের পর এক কনসার্ট, লং ট্রিপ এ রকম হরেক রকম চাঞ্চলতার সঙ্গে কেটে যায় আমাদের শহুরে শীতের দিনগুলো। কাকডাকা ভোর, দূরে ফ্যানভাঙা চরের ছোট্ট টিনের একচালা মসজিদ থেকে ব্যাটারির মাইক থেকে ভেসে আসে আজানের ধ্বনি কুলসুম বেগমের কানে। আর তখনই সকাল শুরু হয় কুলসুম বেগমদের।

ভাপা পিঠা, পুলি পিঠা, খেজুরের রসের কত না রসনা, সঙ্গে মাটির চুলার এক অনন্য কারিশমা ভিন্নতা এনে দেয় মিষ্টান্নগুলোর স্বাদে। কোনো কোনো সকালে রোদের মিষ্টি কিরণে ধবধবে সাদা ভাতের গরম ধোঁয়া আর বেগুন ভর্তা অন্যরকম খাদ্যব্যাঞ্জনায় পূর্ণ থাকে কুলসুমদের মেন্যুকার্ড। দুপুরে জিওল মাছের ঝোল, গরিবের ঘরে রাতে হাঁসের মাংস অন্যরকম এক তৃপ্তি এনে দেয়। জারি গান, পালা গানের আয়োজন কুলসুমদের মাঝরাত অবধি বিনোদনের খোরাক। সারা দিনের কায়িকশ্রমের ক্লান্তির অবসান ঘটায় লোকীয় আয়োজনগুলো। অনেককাল আগে আমাদের শীত নিবারণে ছিল সোয়েটার, ব্র্যান্ডের নানা গরম কাপড়। এখন অবশ্য গৃহবন্দি জীবনে ওসব লাগে না। এয়ার কন্ডিশনারের কারণে আমাদের নতুন করে ভাবা লাগে না শীতকে মোকাবিলা করা নিয়ে। কুলসুম বেগমরা হাহাকার করে একটি কম্বল পাওয়ার আশায়, যেখানে স্বামী-সন্তান নিয়ে একটুখানি উষ্ণতা পাবে বলে। শীত শেষে আয়েসের জীবন ঘুচে যায় আমাদের শহরবাসীর জীবন থেকে। আবারও অপেক্ষা করা লাগে আগামী বছরের এ সময় অবধি। কিন্তু কুলসুম বেগমদের! না, ওদের আয়েসী জীবনে অপেক্ষা নামক কোনো বালাই নাই। ওরা দরিদ্রতাকে জয় করতে শিখেছে, শিখেছে প্রকৃতিকে উপভোগ করতে। ওরা জানে বেঁচে থাকার মানে। বাস্তবে ওরাই জীবনযুদ্ধে সফল এক একটি গল্প।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close