সুস্মিতা চক্রবর্তী

  ০২ ডিসেম্বর, ২০২৩

পথশিশু

সুদীপ্ত ও নূরনবী খুব ভালো বন্ধু। এক দিন ওরা ঠিক করল পথশিশুর সঙ্গে কথা বলে তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানবে ও কিছু সাহায্যও করবে। তারা বাজার থেকে কিছু খেলনা, বই, চকোলেট ও ফল নিয়ে পথশিশুদের উদ্দেশে যাত্রা করল। একটা বস্তির কাছে গেলেই দেখতে পেল কিছু পথশিশু কাগজপত্র কুড়াচ্ছে। আরেকটা পাশে দেখতে পেল কিছু পথশিশু মাদকদ্রব্য সেবন করছে এবং অন্য একদল মাদকদ্রব্য যারা চায় তাদের তা দেওয়ার কাজ করছে বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে। কেউ ফুলের মধ্যে, কেউ প্যাকেটের মধ্যে আবার কেউ পানের মধ্য দিয়েও মাদকদ্রব্য লেনদেন করছে। ভালোভাবে খেয়াল না করলে বোঝারও উপায় নেই। ছোট শিশু বলে কেউ সহজে এদের সন্দেহও করবে না। এ অবস্থা দেখে তাদের খুব খারাপ লাগল।

তারা যে পথশিশুরা মাদকদ্রব্য সেবন ও আদান-প্রদান করছে ওদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল এসব কাজ করার কারণ কী? পথশিশুদের ওরা বলল, মাদকদ্রব্য সেবন করা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং মাদকদ্রব্য কাউকে দেওয়া ও খারাপ কাজ। তোমরা পুষ্টিকর খাবার না খেয়ে মাদক সেবন করে কী উপকার পাও? আমরা তোমাদের জন্য চকলেট ও ফল এনেছি, এগুলো খাও। তখন পথশিশুরা প্রত্যুত্তরে বলল, ও আচ্ছা, মোবাইল বের করে লাইভ ও ভিডিও করবেন না? সুদীপ্ত অবাক হয়ে বলল, লাইভ ও ভিডিও এর কথা কেন বলছো? পথশিশুদের একজন উত্তর দিল আপনারা তো আমাদের কিছু দিতে আসেন ভিউজ ও টাকা পাওয়ার জন্য। এটা কী আমরা জানি না ভাবছেন? আর শুনেন উপদেশ দেওয়া এই পৃথিবীর সবচেয়ে সোজা কাজ কিন্তু আসল কাজ করা কঠিন। তখন নূরনবী বলল, আমরা শুধু উপদেশ দিচ্ছি? আমরা তো তোমাদের জন্য চকলেট ও ফলও এনেছি। আরেকটা পথশিশু বলল, আপনারা আমাদের উপদেশ দেন, নীতিবাক্য শোনান কিন্তু আমাদের খাবারের চিরস্থায়ী একটা ব্যবস্থা করেন না। আপনারা তো আমাদের এক দিন বা কয়েক দিনের জন্য খাবার দিয়ে যান, অন্যদিন আমরা খাবার পায় কি না, খাবার খেয়েছি কি না সেই খবর তো আর আপনারা রাখেন না। প্রতিদিন খাবার পেলে কেউ এসব কাজ করে না। আমাদেরও এগুলো করতে ভালো লাগে না কিন্তু কী করব পেটের ক্ষুধা ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ মানে না।

আহ! বড়লোকরা যত টাকা অবলীলায় খরচ করে সেই টাকাও যদি আমাদের দিত আমাদের খাবারের জন্য অন্তত কয়েক দিন হলেও এসব করতে হতো না। আমাদের বন্ধু জামাল চা বিক্রি করত। এক দিন এক ক্রেতা তার কাছ থেকে চা নিয়ে প্রায় পুরোটা চা খেয়ে বাকি চা গরম নেই বলে জামালের মুখে ছুড়ে মেরেছিল। একটু ভাবুন গরম না হলে কাপের বেশির ভাগ চা তিনি কীভাবে খেয়েছিলেন? যেটুকু চা খেয়েছিল সেটার দামও দেয়নি। করিম জুতা পালিশের কাজ করত। একজন বড়লোক জুতা পালিশ করিয়ে ভালোভাবে পালিশ হয়নি বলে সেই জুতাটি দিয়েই করিমকে মেরেছিল। এসব ভালো কাজে বেতনও ভালো পাওয়া যায় না। ক্রেতারা কাজ করিয়ে কাজ ভালো হয়নি বলে বেতন তো দেয়ই না আবার অত্যাচারও করে। এবার বলেন ভালো কাজ করে লাভ কী?

নূরনবী বলল, তোমাদের বাবা-মা কোথায়? উনারা তোমাদের খোঁজখবর রাখে না? তোমাদের খাবারের ব্যবস্থা করে না? কামাল নামের একজন পথশিশু জানাল, আমার বাবা নেই। মা একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন। ওই ফ্যাক্টরির মালিক ৩ মাস কোনো বেতন দেননি। বেতন চাইলে বলে পোষালে কাজ করো না করলে চলে যাও। আমাদের কর্মীর অভাব হবে না। সাদ নামের একজন পথশিশু বলল, আমার বাবা একটা স্টিলের কারখানায় কাজ করতেন, এক দিন দুর্ঘটনায় আমার বাবা তার একটা হাত হারান। আমার আম্মু একটা বাসায় কাজ করতেন। ওই ঘরের গৃহকর্ত্রী আমার মাকে ২ মাস বেতন দেননি। তৃতীয় মাসে চুরির অপবাদ দিয়ে সেই কাজ থেকে তাড়িয়ে দেন। তখন আমার আম্মু গত ২ মাসের বেতন চাইলে উনি বলেন, চোরের আবার কীসের বেতন? আমার বাসায় চুরি করে কত টাকার জিনিস সরিয়েছে কে জানে! আবার বেতন চায় কোন সাহসে? এখন বিদায় হ, না হলে পুলিশে দেব। অথচ তিনিই আমার বোনকে একটা কাপ ভুলে ভেঙে ফেলেছিল বলে হাতে ছেঁকা দিয়েছিলেন। আমরা তখন শুধু হাতের চিকিৎসার জন্য টাকা চেয়েছিলাম। উনি তাও দেননি। তখন আমরা পুলিশের কাছে বিচার চাইতে গিয়েছিলাম কিন্তু আমরা তো গরিব, বিচারও পেলাম না। আমাদের অভিযোগও পুলিশ ভালোভাবে না শুনে বলে দিলেন আমরা মিথ্যা বলছি। আমরা নির্দোষ হয়েও নিজেরা ভুক্তভোগী হয়েও মিথ্যা অপবাদ পেয়েছিলাম। সেদিনও বড়লোকদের টাকার কাছে আমাদের নিরাপত্তা, অধিকার ও সত্যতা বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। আমাদের সবারই জীবনে এ রকম গল্প আছে।

সুদীপ্ত বলল, তোমরা পড়ালেখা করো না? পড়াশোনা করলে এক দিন তোমাদের সুদিন আসবে। তখন একজন পথশিশু হাসাল! যেখানে জীবনের নিশ্চয়তা নেই, আজ খেতে পারলে পরের দিন খেতে পারব কি না তার ঠিক নেই, সেখানে পড়াশোনা করা বিলাসিতা। এবার সুদীপ্ত ও নূরনবীর কিছুই আর বলার থাকল না। নীরবে তারা স্থান ত্যাগ করল।

শিক্ষা-উপদেশ ও লোকদেখানো উপহারসামগ্রী না দিয়ে পথশিশুদের মৌলিক চাহিদা নিয়ে ভালো জীবনযাপন যাতে করতে পারে, সেজন্য তাদের বাবা-মার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close