শেখ এ কে এম জাকারিয়া

  ০২ ডিসেম্বর, ২০২৩

গ্রামীণ খেলা কুতকুত

গ্রামীণ খেলা কুতকুত। এই খেলার আরেক নাম এক্কাদোক্কা। কুতকুত বা এক্কাদোক্কা যে নামেই ডাকা হোক, এটি কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন পল্লীবাংলার ছয়-সাত বছরের শিশু-কিশোরীদের প্রধান ও লোকপ্রিয় একটি খেলা। শুধু পল্লীতেই নয় মফস্বল কিংবা জেলা শহরের মেয়েরাও এ খেলা খেলে থাকে। গাঁয়ে বাস করে শৈশব ও কৈশোরে এ খেলাটি খেলেনি এমন শিশু বা কিশোরী খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশসহ পশ্চিমবঙ্গের ছোট-বড় সবাই কুতকুত খেলার সঙ্গে পরিচিত। বাড়ির আঙিনায়, ঘরের বারান্দায়, শহরে বাড়ির ছাদে বা যেকোনো খোলা জায়গায় এটি খেলা যায়। সাধারণত বিকেলের নরম রোদে গ্রামীণ কিশোরী ও তরুণীরা কুতকুত খেলায় মেতে ওঠে। তবে কোনো কোনো অঞ্চলে শুধু শিশু-কিশোরীরাই নয় কিশোরদেরও কুতকুত খেলতে দেখা যায়।

এই খেলাটি খেলার জন্য তৈজসপত্রের অর্থাৎ ভাঙা মাটির হাঁড়ি বা কলসির টুকরো দিয়ে চাড় বা চাড়া বানিয়ে বাড়ির উঠুনে কিংবা খোলা জায়গায় নরম মাটিতে আয়তাকার বা বর্গাকৃতির দাগ কেটে কুতকুত খেলার জন্য ঘর বানানো হয়। পল্লীর মেয়েরা সুযোগ পেলেই যেকোনো ঋতুতে এ খেলায় মেতে ওঠে। আয়তাকার ঘর তৈরির পর ঘরের ভেতরে চারটি দাগ কাটা হয়। দাগ কাটার ফলে আয়াতক্ষেত্রটিতে মোট ঘরসংখ্যা হয় পাঁচটি। প্রথম চারটি ঘর আয়তাকার হলেও শেষের ঘরটি অন্য ঘরের চেয়ে একটু বড় ও বর্গাকৃতির হয়। তবে বর্গাকৃতির ঘরটিতে কোনো কোনো অঞ্চলে আড়াআড়ি দাগ টেনে আরো চারটি ঘর তৈরি করা হয়। আবার কোনো কোনো অঞ্চলে কোনাকুণি কোনো দাগ কাটা হয় না। কুতকুত খেলতে কমপক্ষে দুজন খেলোয়াড়ের প্রয়োজন। এই খেলা একা খেলা যায় না। তবে দুই এ-র অধিক হলে কুতকুত খেলায় মজা বেশি।

খেলাটি শুরু করতে হলে প্রথমেই খেলোয়াড়দের দুজনের একজন মাটির হাঁড়ির ভাঙা টুকরা বা চাড়া হাতে নেবে। তারপর প্রতিপক্ষকে জিজ্ঞেস করবে চাড়ার এপিঠ না ওপিঠ? এপিঠ-ওপিঠ নির্ধারণ হয়ে হয়ে গেলে ওপরের দিকে ছুড়ে মারবে। চাড়াটি মাটিতে পড়ার পর যে পিঠ দেখা যাবে, সেই পিঠের মালিক খেলা শুরু করবে। তবে মাটির হাঁড়ির ভাঙা টুকরা বা চাড়াটি এমন হতে হবে, যা এক পায়ে টোকা দিয়ে সরানো যায়। চাড়াটি প্রথম ঘরে ফেলে এক পায়ে দাঁড়িয়ে, দাঁড়ানো পায়ের আঙুল দিয়ে টোকা দেওয়ার সময় মুখে ‘চল কুতকুত’ বলতে বলতে একটি করে চারটি ঘর অতিক্রম করে বর্গাকৃতির ঘরে গিয়ে থামবে। সেখানে দুপা ফেলে একটু জিরিয়ে পুনরায় সব কটা ঘর ঘুরে চাড়াটি দাগের বাইরে নিয়ে আসতে হবে। এরপর দ্বিতীয় ঘরে চাড়া ফেলে চাড়াটি টোকা দিয়ে সবগুলো ঘর অতিক্রম করতে হবে। এভাবে একটি একটি করে সবগুলো ঘরে চাড়া ফেলতে হয়। যে নিয়ম মেনে সবগুলো ঘরে চাড়া ফেলে সবার আগে অভিযান সম্পন্ন করবে, সে-ই বিজয়ী হয়। এই প্রণালিতে কোথাও চাড়া বা পায়ের কোনো অংশ ঘরগুলোর দাগ স্পর্শ করলে, টোকা দেওয়ার সময় একটি ঘর বাদ রেখে অন্য ঘরে চাড়া চলে গেলে, চাড়াটি পা দিয়ে টোকা দেওয়ার সময় ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলে, চাড়া ফেলার সময় দাগে পড়লে কিংবা খেলা শুরুর পর দম ফুরিয়ে গেলে সেই খেলোয়াড় বাতিল হয়ে যায়। তখন অন্য খেলোয়াড় খেলার সুযোগ পায়। স্থানভেদে কুতকুত খেলার নিয়মে কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। যেমন ঘর কমবেশি বা ভিন্ন রকম করে আঁকানো, মুখ ওপরের দিকে তুলে চাড়াটি কপালে রেখে ঘর অতিক্রম করা, চোখ বুজা অবস্থায় দাগে পা পড়লে খেলোয়াড় বাতিল হওয়া, ঘর না দেখে উল্টোদিকে চেয়ে প্রতিটি ঘরে চাড়া ফেলা ইত্যাদি। কিন্তু মূল খেলার নিয়ম প্রায় একই। খেলাটি এখনো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে কিংবা মফস্বল শহরে শিশু-কিশোরীদের কুতকুত খেলতে দেখা যায়। শিশুদের শরীর ও মেধার বিকাশ ঘটাতে খেলাধুলা খুবই দরকারি। এ কারণেই ঐতিহ্যবাহী কুতকুত খেলাটিকে আরো জনপ্রিয় করে তুলতে সরকারি ও স্থানীয়ভাবে খেলাধুলার আয়োজন করতে

হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close