শেখ শান্ত বিন আব্দুর রাজ্জাক

  ২৫ নভেম্বর, ২০২৩

শাকিলার বন্ধু প্রজাপতি

শীতের সকাল। রাজ্যের অলসতা ছুটে এসে সর্বাঙ্গে ও কাঁথা-কম্বলে আষ্টেপৃষ্ঠে লেপ্টে থাকে। মানুষ সকাল সকাল উঠতে চাইলেও পারে না। সূর্যোদয়ের পূর্ব থেকেই শাকিলার আম্মু ওকে ডেকেই চলছে। কিন্তু কিছুতেই ওঠাতে পারছে না। যতই ডাকে শাকিলা ততই ওলের কম্বলখানা শরীরে প্যাঁচায়। অবশেষে ঘুম ভাঙল সকাল ১০টায়। মাদরাসার বেলা আর নেই। চোখ কসলাতে কসলাতে উঠোনের ঝলমলা রোদে গিয়ে দাঁড়ায়। আজ প্রকৃতি যেন নতুন রূপে সেজেছে। শীতকালে এমন মিষ্টি রোদ মাঝেমধ্যেই দেখা যায়। হঠাৎ শাকিলার চোখ পড়ল নয়নতারা ফুলের ওপর। উঠোনের এই ফুলগাছটি ও সখ করে নিজেই লাগিয়েছিল। এই ফুলের সুবাস না থাকলেও অপরূপ সৌন্দর্য দিয়ে মন কেড়ে নেয়। ফুলের পাপড়িতে হরেক রঙে মিশ্রিত কী যেন ঝিলমিল করছিল। সাদিয়া একপা-দুপা করে কাছে গিয়ে দেখে, কী সুন্দর প্রজাপতি! আট বছর বয়সে যত প্রজাপতি চোখে পড়েছে, এত সুন্দর প্রজাপতি আছে বলে কল্পনাও করেনি। সবাই সুন্দরের প্রেমিক। শাকিলা প্রজাপতিকে ছোঁয়ার লোভে ধীরপায়ে এগিয়ে গেল। একেবারে কাছে গিয়ে ধরার জন্য হাত বাড়াল। কী দারুণ ব্যাপার! প্রজাপতিটি উড়ে তো গেলই না উল্টো ওর হাতের ওপর এসে বসল।

শাকিলার মন আনন্দে আটখানা হয়ে গেল। বাম হাতের কোমল আঙুল দিয়ে নকশা করা ডানা দুটি ছুঁইয়ে দিল। এতে করে প্রজাপতিটি সুখ পরশে মাথাগুঁজে রইল। অদ্ভুত সুন্দর প্রজাপতিটি দেখে সাদিয়ার মুখ থেকে মাশাআল্লাহ শব্দটি বের হলো। ভাবতে লাগল, আল্লাহর সৃষ্টি এত সুন্দর হলে না জানি আল্লাহ কত সুন্দর! খালিক মাখলুকের কথা ভাবতে ভাবতে ভাবনার সমুদ্রে ডুবে গেল। নাশতা খাওয়ার জন্য ওর আম্মু কতবার যে ডেকেছে তার অন্ত নেই। কিন্তু একটিও ডাক তার কানে পৌঁছেছে বলে মনে হলো না। কোনো সাড়া না পেয়ে ওর আম্মু নিজেই এসে হাজির কী কাণ্ড! শাকিলা আচমকা দাঁড়িয়ে আছে! জিনে ধরা রোগীর মতো অপলক স্থিরদৃষ্টি। ওর আম্মুর উপস্থিতি দেখে প্রজাপতিটি ডানা মেলে উড়ে গেল। সারাদিন আর দেখা মেলেনি।

পরের দিন শাকিলা মাদরাসা যাওয়ার সময় ফুলগাছটির দিকে তাকাল। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা কুয়াশায় ফুলের ওপর বসে আছে প্রজাপতিটি। শীতে ভিজে আছে নড়েচড়ে না। যেন মরেই গেছে। কিন্তু না! শাকিলা কাছে গিয়ে দেখল, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর খুবই কষ্ট হলো। ভাবল ওকে সাহায্য করা উচিত। কিন্তু সে সুযোগটুকু পেল না। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ওর আম্মু। সারা দিন প্রজাপতিটির জন্য ওর খারাপ লাগল। রাতে ঠিকমতো খেতেও পারেনি। অন্যদিনের তুলনায় একটু আগেভাগেই ঘুমিয়েছিল। স্বপ্নে ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা।

আচমকা কোত্থেকে যে প্রজাপতিটি ওর হাতে এসে বসল। শাকিলা ওকে জিজ্ঞেস করল,

গতকাল তোমার খুব শীত করেছিল, তাই না?

হুঁ। ডানা দুটো ঝাপটিয়ে শব্দ করে উত্তর দিল।

তুমি এত সকাল সকাল উঠছিলে কেন?

তোমাকে দেখার জন্য।

শাকিলা আশ্চর্য হয়ে বলল,

তাই! কেন বলো তো?

তুমি যখন ইউনিফর্ম পরে মাদরাসায় যাও, কী যে সুন্দর লাগে! আমি চেয়ে চেয়ে দেখি। আমার খুব ভাল্লাগে। ইচ্ছে করে তোমার সঙ্গে যাই, পড়াশোনা করি।

আচ্ছা, ঠিক আছে। কালকে আমার সঙ্গে যেও।

উঁ হুঁ, যাব না।

কেন?

অন্য সবাই আমাকে ধরবে, আমাকে নিয়ে মজা করবে। আমার রূপ ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে আনন্দ উপভোগ করবে। আর আমি ব্যথায় মরে যাব, ওরা সেটা বুঝবে না।

চিন্তা করো না, আমি তো আছি। ভয় নেই, কাউকে ধরতে দেব না। আমি একাই এক বেঞ্চে বসব। তুমি আমার সঙ্গে থাকবে।

ঠিক আছে, তবে আমি যাব।

পরদিন শাকিলা ভ্যানে করে মাদরাসায় যাচ্ছিল। হঠাৎ ওই প্রজাপতিটি উড়ে এসে ওর মাথায় বসল। সহপাঠীরা দেখে অবাক! ফারিহা ঠিক থাকতে পারল না। ডান হাত দিয়ে খপ করে ধরে ফেলল। শাকিলা বলল-

ছেড়ে দাও, ও তো ব্যথা পাচ্ছে।

ছেড়ে দেব কেন? আমি কষ্ট করে ধরছি না।

শাকিলা ব্যথিত কণ্ঠে বলল-

ছেড়ে দাও, মরে যাবে তো!

তাতে তোমার কী?

ওটা তো আমার বন্ধু।

কী!

বলছি তো ওটা আমার বন্ধু।

এ কথা শুনে ওর সহপাঠীরা সমস্বরে হাসতে লাগল। ফারিহা একটু মাত্রাতিরিক্ত হেসে বলল-

প্রজাপতি নাকি ওর বন্ধু, হা হা হা।

শাকিলা ওদের ঠাট্টা-মশকারি সহ্য করতে না পেরে ফারিহার হাত থেকে জোর-জবরদস্তি করে প্রজাপতিকে ছেড়ে দিল। এতে করে ছোটখাটো ঝগড়াও বাঁধল। ভ্যানচালক আবুল চাচা ঝগড়া মিট করে দিলেন।

যথাসময় ক্লাস শুরু হলো। বাংলা ম্যাডাম একটি গল্প পড়াচ্ছিলেন। শাকিলা সবার পেছনে একাই একটি বেঞ্চে বসেছে। একটু পর ওই প্রজাপতিটি সবার চোখের সামনে দিয়ে শাকিলার মাথার ওপর গিয়ে বসল। কেউ পাঠে মন বসাতে পারল না।

সবার দৃষ্টি শাকিলার মাথার ওপর। ম্যাডাম শুধালেন,

তোমরা পেছনে কী দেখছো?

শাকিলার বন্ধুকে। সমস্বরে উত্তর এলো।

মানে!

ফারিহা উত্তর দিল, ‘ম্যাডাম, প্রজাপতি ওর বন্ধু। সারাক্ষণ ওর মাথায় বসে থাকে।’

তাই নাকি! দেখি কোথায়?

এই বলে ম্যাডাম কাছে গিয়ে হতবাক! প্রজাপতি এত সুন্দর হয়! কখনোই ভাবেনি। ম্যাডাম সুন্দরকে ছোঁয়ার লোভ সামলাতে পারলেন না। যেই হাত বাড়িয়ে প্রজাপতিটিকে ধরার চেষ্টা করলেন। অমনি ডানা মেলে উড়ে গেল। শাকিলার মন আর স্বাভাবিক রইল না। ভীষণ কষ্ট পেল! আর মনে মনে ভাবল মানুষের কারণেই পৃথিবী থেকে সুন্দরগুলো দিনে দিনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close