আশরাফ আলী চারু
শাপলা ও শালুক ভাই-বোন
অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক দেশে ছিলেন এক রাজা। রাজার ছিল মাতৃহারা দুই সন্তান। তাদের নাম ছিল শাপলা আর শালুক।
রাজা তার সন্তানদের কথা ভেবে একজন মা এনে দিতে চাইলেন। তাই আরেকটা বিয়ে করলেন। রাজার মহান চিন্তা ঠিকই ছিল। কিন্তু দুর্ভাগা শাপলা আর শালুক ঘরে পেল একজন সৎ মা। সৎ মাকে তারা আপন করে নিতে চাইলেও সৎ মা কখনোই সেটা চাইল না।
সৎ মার পছন্দ হলো না শাপলা এবং শালুক রাজবাড়িতে থাকুক। তাই সব সময়ই তাদের হেনস্তা করার জন্য নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নেওয়া শুরু করল সে। রাজার সামনে আদর-সোহাগ দেখালেও রাজার অবর্তমানে সৎ মা রানির নিপীড়ন ছিল অসহ্যরকম। যা নিয়মিত করার মাধ্যমে অতিষ্ঠ করে তুলল শাপলা আর শালুককে।
রাজা দেশ আর প্রজাদের নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকতেন। রানির করা এসব অত্যাচারের ঘটনার কিছুই জানতেন না তিনি। এর আগে এটাও জানতেন না যে এই রানি আসলে একটা ডাইনি। মানুষের রূপ ধারণ করে এই সংসারে এসেছে। তার উদ্দেশ্যই ছিল রাজত্ব দখল করা। তাই নানা রকম পাঁয়তারা করছে সে।
রাজা এসব বুঝতে পেরে রানিকে বন্দি করার জন্য আদেশ করলেন। সেনাপতি এগিয়ে এলেন রানিকে বন্দি করার জন্য। কিন্তু ডাইনি রানি মায়া শক্তি দিয়ে থামিয়ে দিল সেনাপতিকে। উল্টো সেনাপতিকে দিয়ে বন্দি করাল ন্যায়পরায়ণ রাজাকে। সেই সঙ্গে মহা-আনন্দে সিংহাসনে বসল নিজেই। এহেন অবস্থায় রাজার কিছুই করার ছিল না। সৈন্য-সামন্ত সবাই রানির মায়া শক্তিতে পরাস্ত। তিনি বন্দি হয়ে কারাগারে বসে শঙ্কা করতে থাকলেন দুই সন্তানের কী হবে এ বিষয় নিয়ে।
দিন যেতে থাকল। রানি দেশ চালাতে থাকল। শাপলা আর শালুকের প্রতি কারুর কোনো নজর দেওয়ার সুযোগ নেই। তাদের না দেওয়া হয় খাবার, না নেওয়া হয় তাদের যত্ন। অনেক কষ্টের মধ্যে দুই ভাই-বোনের দিন যাচ্ছিল। সেটাও সহ্য হচ্ছিল না ডাইনি রানির। এক রাতে ডাইনি রানি ঘুমন্ত শাপলা আর শালুককে ভাসিয়ে দিল জলে। অনেকক্ষণ পরে শাপলা ও শালুকের যখন ঘুম ভাঙল। বুঝতে পারল তারা ডুবে আছে গভীর জলের নিচে। জলের নিচে দুই ভাই-বোন গলাগলি ধরে খুব কাঁদল। মায়ের কথা মনে হলো তাদের। দুই ভাই-বোন বলাবলি করল নিজের মা থাকলে কী আজ এমন পরিণতি হতো! জলের নিচে এভাবে থাকতে হতো তাদের!
কোথায় যাবে, কী করবে তারা ভেবে পাচ্ছিল না। তাদের এই দুঃখের দিনে কেউ পাশে নেই। বারবার মায়ের কথা বলতে লাগল শাপলা। কাঁদতে থাকল শালুক। কান্না শুনে তাদের মা সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে ছুটে এলো তাদের কাছে। পরম যত্নে বুকে আগলে নিল তার নাড়িছেঁড়া দুই সন্তানকে।
মাকে কাছে পেয়ে শাপলা-শালুকের মনটা ভরে উঠল। কিছুদিনের মধ্যে মায়ের পরম স্নেহ পেয়ে জল পেরিয়ে তরতর করে বাইরের আলোয় বেরিয়ে এলো শাপলা। আর মা এবং বোন যেন মাটির সিংহাসন থেকে কখনোই ভেসে উঠতে না পারে সেজন্য তাদের শক্ত করে জড়িয়ে রাখল শালুক।
তারপর থেকে এভাবেই চলছে তাদের সংসার। কেউ কাউকে ছেড়ে যায় না কখনোই। বর্ষা এলে জলের ওপর ভেসে উঠে শাপলা। গোড়ায় থাকে শালুক। জানান দেয় যুগযুগ ধরে তারা এভাবেই আছে আর থাকবে এভাবেই।
"