মোস্তাফিজুল হক

  ০৩ ডিসেম্বর, ২০২২

পাখিদের মিতা

ভোর ছয়টা। দোয়েল শিস কাটছে। বাতাসে ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে। আলো ঝলমলে ভোর। তাই পাখিরাও সুর ধরেছে। চড়ুই, শালিক আর টুনটুনি কিচিরমিচির করছে। একটানা গেয়ে চলেছে ওরা। অপু একটা মাটির পেয়ালায় কিছু খুদ ঢেলে নিল। তারপর বাগানে চলে গেল। খুদগুলো পাখিদের খাবার। রোজ সে এভাবেই খাবার ছিটিয়ে দেয়। তখন পাখিরা বাগানে নেমে আসে। চড়ুই, টুনটুনি, বুলবুলি, দোয়েল, বনছাতারে, হলদে পাখি এমনকি লাজুক ঘুঘুও নেমে আসে। তবে অপু ছাড়া আর কেউ থাকলে নামে না। তখন শুধু দোয়েল নামে। ফিঙেটার রাজকীয় ভাব। ওটা কখনো নামে না। ওটা যেন মাঠের রাজা। আয়েশ করে গরুছাগলের পিঠে বসে থাকে। তারপর উড়ে গিয়ে ফড়িং নয়তো পোকামাকড় ধরে। ভাবটা যেন এ রকম- রাজা হয়ে কেন খুদকুঁড়ো খেতে যাব?

অপু যেন পাখিদের ভাষা বোঝে। পাখিরাও হয়তো অপুকে বোঝে। তেজপাতাগাছের আড়ালে লুকিয়ে ডাকে ফটিকজল। ভীষণ চড়া গলা। চড়া হলেও খুব সুমধুর গলার সুর। অতটুকুন পাখি। টুনটুনির চেয়ে কিছুটা বড়। দুপুরে সুর ধরে গায়। তখন মনে হয় অপুকেই বলে, কী খাইছো?

আষাঢ়ের দুপুর। ভোরেই মেঘ ঝরেছে। তবে তাপ একটুও কমেনি। ভীষণ গরম। হাঁসফাঁস করছিল অপু। কদমগাছের ছায়ায় এসে বসল সে। হঠাৎ করেই ওর নজর পড়ল একটা পাখি। ইস্! কী মায়াবী পাখি। টকটকে লাল ঠোঁট। বড় দুটো গোলগাল চোখ। সবুজ পালক। ভোঁতা ভোঁতা ঠোঁটে কিছুটা লাজুক লাজুক...

এই যে, আমাকে নিয়ে ভাবছো? অপু অবাক হয়ে মনে মনে বলল, এ যে কথা বলা পাখি!

এই অপু, আমি নেচে নেচে গোসল করব। দেখবে তুমি? অপুর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না। বেরোবে কী? পাখিটা যে ওর নামও জানে। তাই সে অনেকটাই বোকা বনে গেছে। মুখে আওয়াজ না বেরোলেও মন বলেছে, দেখাও দেখি! ওহ্! তোমার নামটাও তো জানা হলো না? আগে নামটা বলো।

আমি বৌরি। তোমাদের এই কদমগাছেই থাকি। খোঁড়লটা তো দেখাই যায়, তাই না? এই খোঁড়লে পানি জমেছে। এতেই আমি নেচে নেচে গোসল করব।

পাখিটা দুটো ডুব দেয়। ডুব দিয়ে উঠে এসে ডালে বসে। পালক ঝাড়ে। ঠোঁট দিয়ে পালক ঘষে। তারপর আবারও ডোবাডুবি করে। এসব দেখে অপুর ভালো লাগে। সে মনে মনে বলে, ভারী চমৎকার করে গোসল করলে তুমি!

কেমন যেন আজব ঘটনা! অপু মনে মনে যা বলে, পাখিটা সে-ও বুঝে ফেলে। আর তাই পাখিটা বলে, আমার গোসল করা দেখে তোমার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম। তুমিও তো গরমে ভিজে একদম জবজবে হয়ে গেলে। সাঁতার কেটে গোসলটা সেরে ফেলো? শরীর আর মন ফুরফুরে হবে। যাও ভাই।

অপু ভাবল, তাই তো। সাঁতার কেটে গোসল করলে গরমে কিছুটা আরাম পাওয়া যাবে। তারপর অপু চলে গেল ভাটিগাঙের ধারে। সেতু থেকে লাফিয়ে পড়ে ডুব সাঁতারে মেতে উঠল সে। এভাবে লাফাতে লাফাতে হঠাৎ একটা দারুণ ঘটনা ঘটে গেল। অপু যেন ডুব দিয়ে নতুন এক জগতের দেখা পেল। সবুজে ঘেরা মায়াবী এক বন। গাছে গাছে কতই না রংবেরঙের ফুল! মন ফুরফুরে করে দেওয়া সেসব ফুলের সুবাস। ডালে ডালে হাজারো ধরনের পাখি। কত রংবেরঙের পালক ওদের! ওরা অপুকে দেখেই সুর ধরে বলল,

পাখির মতো মনটা তোমার

করবে পাখির রাজ,

পালক দিয়ে গড়ব এসো

পাখি রাজার তাজ।

অপু তুমি পাখির মিতা

পাখির আপনজন,

তোমার হয়ে গাইবে পাখি

সাজবে ফুলের বন।

বনের পাখিদের আজ রঙিন ডানার মতোই রাঙানো মন। মনে যেন আজ কোনো ভয় নেই। যার যেমন মন চাইছে, অপুর কাঁধে, হাতে আর মাথায় বসছে। মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অপুর মুখও দেখছে। আহা রে! যেন কত দিন পরে কতটা আপনজনকে ফিরে পেয়েছে। পাখিরা অপুকে ভালোবেসে কত রকমের ফল খেতে দিল। টুনটুনি আর বাবুইয়ের গড়া রাজসিক ঘরে নিয়ে বসতেও দিল। ঘাসের ডগায় আর শিমুল তুলোয় গড়ানো গদির চেয়ার। সে রকম করেই গড়ানো বিছানা। তারপর কখন যেন ঘুমের গভীরে তলিয়ে গেল সে।

অপু দুদিন ধরে বিছানায় শুয়ে আছে। পাখিদের খাবারও দেওয়া হয় না। মা একা মানুষ। সবকিছু সামলে উঠতে পারেন না। এদিকে অপুর শরীরে রেশ উঠেছে। তাপও বেড়ে গেছে। পাখিদের খাবার কখন দেবেন? অনেকটাই অবচেতন অপুকে মা ডেকে বললেন, বাবা, উঠে ওষুধটা খেয়ে নাও। ওষুধ না খেলে তাড়াতাড়ি ভালো হবে কী করে? তখন অপুর মনে পড়ে গেল পাখিদের কথা। ও ঘুমের গভীরে তলিয়ে গিয়ে যা দেখেছে, ওসব ঠিক না হলেও সে যে পাখিদের মনে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছে। তাই অপু এবার গা ঝাড়া দিয়ে বসল। তারপর বলল, আহা! দুদিন থেকে পাখিদের খাবার দেওয়া হয় না!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close