ডা. শারমীন মিজান, পিএইচডি

  ২৩ মার্চ, ২০২৩

পাঁচ বছরের নিচে শিশুর সুষম খাবারের অভ্যাস

শিশুকেন্দ্রিক কোনো আলোচনা সভায় যে বাক্যটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় তা হলো ‘শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ’। বাক্যটির সম্প্রসারিত অর্থ হলো শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে জাতির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। নচেৎ জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন তাদের জন্য সুষম খাদ্যের জোগান; যেন তারা বয়স অনুযায়ী সঠিকভাবে বেড়ে ওঠে। অর্থনৈতিক বাস্তবতায় আমাদের দেশে সবস্তরের অভিভাবক তাদের সন্তানদের জন্য সুষম খাদ্য নিশ্চিত করতে পারেন না। পুষ্টি বিষয়ে অসচেতনাও অনেকাংশে দায়ী। ফলত, সমাজে এক শ্রেণির শিশু বিকাশের ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছে। তারা কারা?

দ্রুত নগরায়ণ ঘটছে এমন দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য মতে, বাংলাদেশে শহরাঞ্চলে বসবাসকারী ৫ কোটি ৩ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই শিশু। বছর-পাঁচেক আগে পরিচালিত ‘চাইল্ড ওয়েল বিয়িং সার্ভে’ এবং এমআইসিএসের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বস্তিতে থাকা শিশুদের অবস্থা গ্রামের শিশুদের চেয়ে অনেক খারাপ। এ অবস্থা বলতে যেসব বিষয় আলোচনায় এসেছে তার মধ্যে শিশুদের খাদ্য তালিকায় পুষ্টিকর উপাদানের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ।

শহরাঞ্চলে দরিদ্র পরিবারগুলোতে বাড়ন্ত শিশুদের পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা বিরাজমান। অনেক বাবা-মা শিশু সন্তাদের মায়ের দুধের সম্পূরক খাবার কখন ও কীভাবে দিতে হবে সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখেন না। অথচ শিশুর জন্মের পর ছয় মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ এবং পরে সম্পূরক হিসেবে পরিমাণমতো শর্করা, আমিষ, খনিজ এবং ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবারের সরবরাহ শিশুটির প্রারম্ভিক বিকাশের জন্য খুবই জরুরি। কারণ, বয়স উপযোগী পুষ্টিকর খাবার খাওয়ালে শিশুটির রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি তার শারীরিক গঠন উন্নত হবে।

দুঃখের বিষয়, দেশে তীব্রতম অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের বাবা-মায়ের অসচেতনতা এই সংকট মোকাবিলায় বড় বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির তীব্রমাত্রার প্রকোপ বেড়েছে অনেক বেশি। ২০২১ সালে তীব্রতম অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুর সংখ্যা ছিল ২০২০ সালের তুলনায় ৭২ শতাংশের বেশি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী তীব্রতম অপুষ্টি পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের অসুস্থতা ও মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের সিটি করপোরেশন ও বিভাগীয় শহরের বস্তিতে পাঁচ বছরের কম বয়সি ৪০ শতাংশ শিশু অপুষ্টিজনিত খর্বকায় অর্থাৎ বয়স অনুযায়ী তাদের যে দৈহিক উচ্চতা থাকার কথা ছিল তা হয়নি। অপুষ্টির কারণে শিশুরা অসুখণ্ডবিসুখে আক্রান্ত হয় বেশি। এমন শিশুরা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার ঝুঁকিতে থাকে। তাদের কর্মদক্ষতাও অন্যদের তুলনায় কম থাকে।

আমরা সবাই জানি, জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে নবজাতককে অবশ্যই মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। এ দুধে এমন অনেক উপাদান থাকে, যা শিশুকে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া প্রতিরোধী করে তোলে। ইউনিসেফের প্রতিবেদন জানাচ্ছে, এ দেশে দরিদ্র পরিবারে নবজাতককে মায়ের দুধ খাওয়ানোর হার ৪৮ দশমিক ১ শতাংশ, যেখানে ধনী পরিবারে এ হার ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ। সরকারি হিসাবে বছরে পাঁচ বছরের কম বয়সি যত শিশুর মৃত্যু, তার বেশির ভাগই হয় নিউমোনিয়া এবং ডায়রিয়ার কারণে। কোনো শ্রেণির পরিবারে শিশুমৃত্যুর হার বেশি তা সহজেই অনুমেয়।

বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পথে অনেক এগিয়েছে। এখন মানুষের খাদ্য তালিকায় পুষ্টিকর উপাদানের উপস্থিতি বাড়ানোর ব্যাপারে সরকার উদ্যোগী হয়েছে। সরকারের এই উদ্যোগকে সফল করতে, বিশেষ করে শহরে বসবাসকারী দরিদ্র পরিবারে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো উৎসাহিত করতে, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় কাজ করছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের নেতৃত্বে আরবান প্রাইমারি হেল্থ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রজেক্ট (ইউপিএইচসিএসডিপি) নামের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ১১টি সিটি করপোরেশন এবং ১৩টি পৌরসভা এলাকায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী, মা ও শিশুদের স্বল্পমূল্যে উন্নত প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পাশাপাশি বাবা-মাকে তাদের পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের সুষম খাবার খাওয়ানোর বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে।

অসচেতন বাবা-মা সুষম খাবারকে ব্যয়বহুল মনে করে থাকেন। এই ধারণা যে ভুল, সহজলভ্য অনেক খাবারই যে পুষ্টিকর, সে সম্পর্কে তাদের অবহিত করতে হবে। শিশুদের প্রতিদিনের আহারে খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি উপাদানের যথাযথ সমন্বয়ে সুষম খাদ্যতালিকা তাদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। এ কাজে প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট সেবাপ্রদানকারীদের আন্তরিকতার পাশাপাশি বাবা-মাকেও সচেতন হতে হবে। নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে বাবা-মাকেই উদ্যোগী হতে হবে।

লেখক : সহকারী-প্রকল্প পরিচালক (সার্ভিস ডেলিভারি)

আরবান প্রাইমারি হেলথ্ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রজেক্ট- দ্বিতীয়পর্যায়

স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close