নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১২ জুন, ২০২৪

বিনামূল্যে সরকারি বাড়ি গৃহহীনদের আত্মমর্যাদা এনে দিয়েছে : প্রধানমন্ত্রী

দেশের ৫৮ জেলা ভূমি ও গৃহহীনমুক্ত

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় বিনামূল্যে দেওয়া বাড়িগুলো গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা এনে দিয়েছে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে আমরা বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে মানুষকে বিনামূল্যে ঘর দিয়ে পুনর্বাসন করেছি। এতে তাদের জীবনে পরিবর্তন এসেছে। আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ ফিরে এসেছে। একটি দেশকে উন্নত করতে হলে এর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

গতকাল মঙ্গলবার সকালে সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি তার সরকারের সারা দেশের গৃহহীনদের বিনামূল্যে ঘর দেওয়ার জন্য গৃহীত আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় দেশের ১৮ হাজার ৫৬৬টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমিসহ ঘর হস্তান্তর কার্যক্রমের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া গৃহহীনদের মধ্যে বিনামূল্যে ঘর বিতরণের অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ওপর একটি ভিডিও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ঈদ উপহার হিসেবে এসব ঘর দিয়েছি। সরকারের লক্ষ্যই হচ্ছে দেশবাসীর সেবা করা। কারণ দেশের জনগণের আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা থাকায় তারা বারবার আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনে।’ ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এককভাবে ২৩৩টি আসনপ্রাপ্তির উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছিল আমাদের ওপর। কাজেই যেসব মানুষ আমাদের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছে, তাদের সেবা করাই আমাদের দায়িত্ব। সরকারপ্রধান বলেন, ‘ঠিক আমার বাবা যেভাবে নিজেকে বাংলাদেশের জনগণের সেবক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেভাবেই তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশের মানুষের সেবা করাকেই আমি কর্তব্য বলে মনে করি।’ শেখ হাসিনা বলেন, লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত এ বাংলাদেশ কখনো পিছিয়ে থাকতে পারে না। এ বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে যেতেই হবে। এদেশের মানুষ ক্ষুধা-দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাবে। প্রতিটি মানুষের জীবন সুন্দর হবে, সেটাই আমাদের লক্ষ্য। সে লক্ষ্য বাস্তবায়নেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিছুদিন আগে যে ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস (রেমাল) হয়ে গেল, সেখানে হাজার হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরই মধ্যে আমরা তালিকা করেছি- কোন কোন এলাকায় কতগুলো ঘর সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। কতগুলো আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। যেগুলো সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত তাদের আমরা ঘর তৈরি করে দেব। আর ক্ষতিগ্রস্তদেরও আমরা ঘর পুনর্নির্মাণে সহায়তা করব। তিনি বলেন, এ প্রাকৃতিক দুর্যোগে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের পাশে আমরা আছি। প্রাথমিকভাবে যা যা প্রয়োজন, তা করে যাচ্ছি এবং ঘরবাড়ি যাদের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আমি তাদের এটুকু বলতে চাই- আপনাদের চিন্তার কোনো কারণ নেই। প্রত্যেকেই নতুন ঘর যাতে পান, সেই ব্যবস্থা ইনশাআল্লাহ আমি করে দেব এবং সেভাবেই আমরা এরই মধ্যে প্রস্তুতি নিয়েছি। প্রত্যেক এলাকা থেকেই আমরা তথ্য সংগ্রহ করেছি এবং সে অনুযায়ী আমরা এ সহায়তা পাঠাব।

শেখ হাসিনা লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ, কক্সবাজারের ঈদগাঁও এবং ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত হয়ে সুবিধাভোগীদের মধ্যে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জমির মালিকানা দলিলসহ বাড়ি হস্তান্তর করেন। পরে তাদের সঙ্গে মতবিনিময়ও করেন। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের পঞ্চম পর্বের দ্বিতীয় ধাপে এদিন ১৮ হাজার ৫৬৬টি গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারকে বাড়ি হস্তান্তরের পাশাপাশি তিনি ২৬ জেলার সব উপজেলাসহ আরো ৭০ উপজেলাকে ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষমুক্ত ঘোষণা করেন। নতুন ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত জেলা ও উপজেলা নিয়ে সারা দেশে জেলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৮ এবং উপজেলা হয়েছে ৪৬৪টি। এর আগে প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের প্রথম ধাপে ৬৩ হাজার ৯৯৯টি, দ্বিতীয় ধাপে ৫৩ হাজার ৩৩০, তৃতীয় ধাপে ৫৯ হাজার ১৩৩ এবং চতুর্থ ধাপে ৩৯ হাজার ৩৬৫টি বাড়ি বিতরণ করেন।

প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীন ও গৃহহীন প্রতিটি পরিবারকে ২.৫ শতক জমির মালিকানা দিয়ে একটি আধাপাকা বাড়ি দেওয়া হচ্ছে, যা স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই নামে হবে। প্রতিটি বাড়িতে দুটি বেডরুম, একটি রান্নাঘর, একটি টয়লেট এবং বারান্দা রয়েছে। প্রকল্পের বিবরণ অনুযায়ী, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম পর্যায়ের প্রথম ধাপে ২ লাখ ৬৬ হাজার ১২টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। সরকারপ্রধান বলেন, আমার দেশের যারা ভূমিহীন-গৃহহীন আছে, তাদের আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে আশ্রয়ের ব্যবস্থা, জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। ফলে তাদের জীবন বদলে গেছে। এ সময় তিনি ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ এবং প্রতি ইঞ্চি অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় আনার মাধ্যমে সার্বিক উৎপাদন বাড়াতে দেশবাসীর প্রতি তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। তিনি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। আর সে কারণেই আমাদের এ প্রচেষ্টা। ঘরগুলো নির্মাণের কাজে জড়িতদের প্রধানমন্ত্রী তার এবং জনগণের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।

প্রধানমন্ত্রী এদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মিথ্যা মামলায় কারাভোগ থেকে মুক্তি পাওয়ায় দিনটিকে তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছিল, খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতেও মিথ্যা মামলা দিয়েছিলেন। আবার সেই সময়কার যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, তারাও গ্রেপ্তার করে পরে মিথ্যা মামলা দেয়। তিনি এ সময় আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের সব নেতাকর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াইকারী-প্রতিবাদী সাধারণ জনগণকে স্মরণ করে ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ঢাকা শহরে ১৫ দিনের মধ্যে ২৫ লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহ করে আমাদের মহানগর আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতারা উপদেষ্টার অফিসে পৌঁছে দেয়। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় এবং আজ ১১ জুন (গতকাল) আমি সেই বন্দিখানার থকে মুক্তি পাই। তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভূমিকাও এ সময় স্মরণ করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহান আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই জাতির পিতার নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম, কিন্তু সেই স্বাধীনতার সব সুফল মানুষের ঘরে পৌঁছানোর আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যা করে সবকিছু যেন পাল্টে দেওয়া হয়। দেশ চলে আসে যুদ্ধাপরাধী ও খুনিদের হাতে। এদেশের ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে আশ্রয়দানের জন্য জাতির পিতা সর্বপ্রথম নোয়াখালীতে (এখনকার লক্ষ্মীপুর) ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষের মাঝে ঘর ও খাসজমি বিতরণ শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের প্রতিটি ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে ঘর ও ফসল উৎপাদনের জন্য ভূমিদান করা এবং সব খাসজমি সহায়-সম্বলহীন মানুষের মাঝে বিতরণই ছিল তার লক্ষ্য। যেন কোনো মানুষ ভূমিহীন ও গৃহহীন বা ঠিকানাবিহীন না থাকে। কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আমরা দেখেছি, সেই উদ্যোগ আর কারো ছিল না।

শেখ হাসিনা বলেন, অবৈধভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতাসীনরা এদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতেই ব্যস্ত ছিল। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে তার সরকার আবার ক্ষমতায় এলে তার সরকার আশ্রয়ণ প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প নিয়ে ভূমিহীন-গৃহহীনদের আবারও পুনর্বাসন শুরু করে। ১৯৯৭ সালে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৭০টি পরিবারকে প্রথমে সেন্টমার্টিন দ্বীপে ঘরে করে দেওয়া হয়। প্রথম অবস্থায় জায়গার অভাব থাকায় ব্যারাক হাউস নির্মাণ করে পৃথক ঘর ও ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় এবং আশ্রয়ণ প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়।

জমিসহ ঘর পেয়ে চোখে পানি তাদের : নদীভাঙনে বিলীন হয়েছিল বাবা ও শ্বশুরের ভিটাবাড়ি। সেই থেকে ভূমিহীন-গৃহহীন বিবি আয়েশা। এরই মধ্য দুই মেয়ে ও চার ছেলে রেখে মারা যান স্বামী। সব কূল হারিয়ে জীবনের অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাওয়াকেই নিয়তি মেনেছিলেন বিবি আয়েশা। কেউ পাশে দাঁড়াবেন- ছিল তার কল্পনারও বাইরে। কিন্তু দুস্থ-নিঃস্ব সবহারা মানুষকে নিয়ে যার সবসময়ের ভাবনা, সেই শেখ হাসিনা ঠিকই খুঁজে নিয়েছেন বিবি আয়েশাকে। তাকে দিয়েছেন নতুন ঘর। এ ঠিকানা ঘিরে এখন তিনি দেখছেন নতুন দিনের স্বপ্ন। দ্বীপ জেলা ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার চর কচ্ছপিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পাওয়া বিবি আয়েশা জানান, নতুন ঠিকানা পেয়ে কীভাবে তিনি নতুন জীবন পেলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিবি আয়েশা বলেন, ‘মাইনসের বাড়িতে উরকাইত থাকছি, কত কষ্ট করছি। আমাগে কেউ নাই, আল্লাহ আমাদের একজন শেখ হাসিনা দিছেন। হের বাপেও (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) আমাগে লাইগ্যা করছে, হেও (শেখ হাসিনা) করতেছে।’ তিনি বলেন, ‘একসময় আমাগে সবই ছিল। নদী সব খেয়ে ফেলেছে। পোলাপাইনের বাপের বাড়ি ছিল আলিমুদ্দি বাংলাবাজার। আমার বাপের বাড়ি ছিল হাজীপুর। অভাবের সময়ে স্বামীও চলে গেছে। এক পোলাও মরে গেছে। দুই পোলা অন্য জায়গায় থাকে। মেয়েরা গার্মেন্টে কাজ করে। ছোট ছেলেকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ঘরে থাকি। এজন্য প্রতি ওয়াক্তে নামাজ পড়ে শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করি। আমি যেন শান্তিমতো থাকতে পারি, সেজন্য যে ঘর দিল তার জন্য দোয়া করব না তো কার জন্য দোয়া করব।’ প্রায় একই অনুভূতি জানিয়ে ঘর পাওয়া জাহাঙ্গীর মাঝি প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, একসময় আমার ঘর ছিল, ঝড়ে ভেঙে গেছে। ছেলেমেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে ছিলাম। আপনার কারণে আবার ঘর পেয়েছি। এখন অনেক সুখে আছি, শান্তিতে আছি।

দেশের ৫৮ জেলা ভূমি ও গৃহহীনমুক্ত : দেশের আরো ২৬টি জেলা এবং ৭০টি উপজেলাকে ভূমি ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে এখন পর্যন্ত ৫৮টি জেলা ও ৪৬৪টি উপজেলা ভূমি ও গৃহহীনমুক্ত হলো।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close