মেহেদী হাসান

  ১১ জুন, ২০২৪

হয়রানির আরেক নাম প্রিপেইড মিটার

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) এক গ্রাহক প্রিপেইড মিটারে ২ হাজার টাকা রিজার্চ করেন। কিছু সময় পর ডিপিডিসি থেকে মুঠোফোনে একটি বার্তা আসে। তাতে ডিমান্ড চার্জ বাবদ ৮৪ টাকা, মিটার ভাড়া ৪০, রেয়াত ৯.৩২ এবং ভ্যাট ৯৫.২৪ টাকাসহ ২৩১ টাকা কর্তন করা হয়। মিটারে জমা হয় ১ হাজার ৭৬৯ টাকা। ওই গ্রাহক বলেন, দেশের মানুষের কপাল এতটাই খারাপ, নিজের পকেটের টাকা কোথায় যাচ্ছে, তা জানার অধিকারটুকু নেই। বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটারে বিলের নামে যৌক্তিক না অযৌক্তিকভাবে টাকা নিচ্ছে- বিদ্যুৎ বিভাগের সঠিক কোনো উত্তর সাধারণ মানুষ জানতে পারছেন না।

শুধু ওই গ্রাহকই নন, বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটারে ভোগান্তির অভিযোগ অনেকের। সর্বশেষ সাধারণ জনগণের পক্ষে জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুতের বিলিং প্র্যাকটিস পর্যালোচনা ও নিরীক্ষা, স্বচ্ছতা, অতিরিক্ত চার্জের রিফান্ড, জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগ এবং নীতি সংস্কার করার দাবি জানিয়ে সংশ্লিষ্টদের লিগ্যাল নোটিস পাঠানোর ঘটনা ঘটেছে। আসলে প্রিপেইড মিটারে অতিরিক্ত খরচ নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে বিলিং প্র্যাকটিস পর্যালোচনা ও নিরীক্ষা, স্বচ্ছতা, অতিরিক্ত চার্জের রিফান্ড, জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগ এবং নীতি সংস্কার প্রয়োজন বলে দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

গ্রাহকদের অভিযোগ, প্রিপেইড মিটার চালু হওয়া সত্ত্বেও ভোক্তারা অতিরিক্ত চার্জ, গোপন চার্জ এবং স্বচ্ছতার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। সমস্যাগুলো ব্যাপক অসন্তোষ ও আর্থিক কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। নতুনভাবে বিলি করা প্রিপেইড মিটারের সঠিক কোনো তথ্যই সাধারণ মানুষের কাছে নেই। তারা অনেকটা হাওয়ার ওপর বিল দিচ্ছেন। বিকাশ বা নগদ কিংবা অন্য কোনো অ্যাপস থেকে পরিশোধ করা বিল আসলেই জায়গামতো যাচ্ছে, নাকি অন্য কোথাও যাচ্ছে, তা-ও তারা জানতে পারেন না। কারণ তাদের কাছে কোনো হার্ড কপি থাকছে না। মোবাইল মেসেজটাই একমাত্র প্রমাণ, যা কোনোভাবে ডিলিট হয়ে গেলে একমাত্র শেষ প্রমাণও মুছে যাবে।

অনেকের মতোই ভুক্তভোগী এস এম মাহবুবুর রহমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, একজন গ্রাহক মাসে কতবার বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করবে? মাসে দুই বা ততোধিক বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। আরো অনেক ইউটিলিটি বিল আছে। সব মিলিয়ে আয়ের বড় অংশ ইউটিলিটি বিলে চলে যাচ্ছে। থাকাণ্ডখাওয়া ছেলেমেয়ের স্কুল-কলেজের বেতনসহ আরো অনেক খরচ আছে, যা মেটাতে সাধারণ মানুষের আয়ে যথেষ্ট প্রভাব ফেলছে। ডিমান্ড চার্জ বাবদ যে টাকা কেটে নেওয়া হচ্ছে, তা অনেক বেশি। এটা জুলুমের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ২ হাজার টাকা রিচার্জ করলে প্রায় ২৩০ টাকা কর্তন করে বিদুৎ বিভাগ। এটা কমানো উচিত।

প্রিপেইড মিটার বিষয়টিকে রীতিমতো ব্যাপক ভোগান্তির কারণ বলে মনে করছেন পল্লী বিদ্যুতের সাধারণ গ্রাহকরা। প্রিপেইড মিটারের নানা জটিলতার কথা তুলে ধরে জনভোগান্তি দূর করতে স্মার্ট প্রযুক্তি চালুর দাবি জানান তারা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, প্রিপেইড মিটার গ্রাহকদের ভোগান্তি বাড়িয়ে তুলেছে। টাকা লোড করতে গ্রাহককে ২০টি ডিজিট চাপতে হয়। টাকা লোড করার সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত বিল কেটে নেওয়া হচ্ছে। টাকা শেষ হলেই বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গ্রাহকের বিদ্যুৎ লোড সম্পর্কে ধারণা না থাকায় বিল বেশি যাচ্ছে, নাকি কম যাচ্ছে, তা ধরা যায় না। পোস্টপেইড মিটারের চেয়ে প্রিপেইড মিটারের খরচ বেড়ে যাওয়া, ডিমান্ড চার্জ, মিটারে লোড বাড়াতে ভোগান্তিসহ নানা বিপত্তি ঘটছে। তবে বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। দেওয়া হয়েছে বেশকিছু যুক্তি।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ নোমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, পোস্টপেইড মিটারের চেয়ে প্রিপেইড মিটারের খরচ বেড়ে যাওয়া, ডিমান্ড চার্জসহ এরকম আরো কয়েকটি বিষয় নিয়ে অভিযোগ আগে থেকে আমরা পাচ্ছি। সহজে এসব বিষয় বোঝানো যাবে না। আমাদের প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বললে এটার ব্যাখ্যা দিতে পারবে। এর বেশি এখন আমি বলতে পারব না।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সিলেট সেলস অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন ডিভিশন-৩ জোনের সহকারী প্রকৌশলী মো. মোকাম্মেল তরফদারের সঙ্গে কথা হয় প্রতিদিনের সংবাদের। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, যে গ্রাহক খোলাবাজার থেকে মিটার সরবরাহ করেন, সেই গ্রাহকের থেকে প্রতি মাসে মিটার ভাড়া কেটে রাখা হয় না। শুধু অফিস থেকে বিনামূল্যে যে প্রিপেইড মিটার সরবরাহ করা হয়, সে মিটারের ভাড়া ৪০ টাকা করে কেটে রাখা হয়। একটি সিঙ্গেল ফেজ মিটারের লাইফ সাইকেল যদি ১০ বছর হয়, তবে গ্রাহক ১০ বছরে ৪ হাজার ৮০০ টাকা মিটার ভাড়া দেবেন, যা ৬ হাজার টাকা থেকেও কম। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিতরণ অঞ্চলে পিডিবি কর্তৃক থ্রি ফেজ মিটার সরবরাহ করা হয়। প্রতিটি থ্রি ফেজ মিটারের দাম ২২ হাজার ৭২৩ টাকা। যদি গ্রাহক ভাড়ায় মিটার নিতে চান, তবে ২৫০ টাকা করে প্রতি মাসে কেটে রাখা হয়। একটি থ্রি ফেজ মিটারের লাইফ সাইকেল যদি ৭ বছর হয়, তবে গ্রাহক ৭ বছরে ২১ হাজার টাকা মিটার ভাড়া দেবেন, যা ২২ হাজার ৭২৩ টাকা থেকেও কম। গ্রাহক যদি নিজ টাকায় মিটার কিনে থাকেন, তাহলে কখনোই গ্রাহককে মিটারের ভাড়া দিতে হয় না।

বিদ্যুতের লোড নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিঙ্গেল ফেজ মিটারে গ্রাহক সর্বোচ্চ ৭.৫ কিলোওয়াট লোড ব্যবহার করতে পারে এবং থ্রি ফেজ মিটারে গ্রাহক সর্বোচ্চ ৫০ কিলোওয়াট লোড ব্যবহার করতে পারে। গ্রাহক প্রতি মাসে তার অনুমোদিত লোড অনুযায়ী ডিমান্ড চার্জ দেন। প্রিপেইড মিটারে অনুমোদিত লোড অপেক্ষা বেশি লোড ব্যবহার করলে মিটার সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে যায়। ডিমান্ড চার্জ বিষয়ে বলেন, ডিমান্ড চার্জ প্রতি মাসে একবার বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেই দিতে হয়। ডিমান্ড চার্জ ধনী-গরিবের জন্য নির্ভর করে না, বরং নির্ভর করে অনুমোদিত লোড ও ট্যারিফের ওপর। যেমন একজন ক্ষুদ্র আবাসিক গ্রাহকের অনুমোদিত লোড যদি ২ কিলোওয়াট হয়, সর্বশেষ বিদ্যুতের খুচরা মূল্যহার অনুযায়ী প্রতি কিলোওয়াট আবাসিক লোডের জন্য ৪২ টাকা ডিমান্ড চার্জ, তাহলে ওই ক্ষুদ্র আবাসিক গ্রাহককে ৮৪ টাকা ডিমান্ড চার্জ দিতে হবে এবং তিনি যদি ৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন, তবে তার প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ব্যতীত ৫.২৬ টাকা, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ক্ষেত্রে ৪.৬৩ টাকা হারে বিদ্যুৎ বিল হবে।

আবার একজন বড় আবাসিক ভোক্তার অনুমোদিত লোড বেশি হওয়ার কথা ধরি, তার অনুমোদিত লোড ৭ কিলোওয়াট হলে তাকেও প্রতি কিলোওয়াট আবাসিক লোডের জন্য ৪২ টাকা ডিমান্ড চার্জ হলে প্রতি মাসে ২৯৪ টাকা ডিমান্ড চার্জ দিতে হবে এবং প্রতি মাসে হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে তাকে প্রথম ৭৫ ইউনিটের জন্য ৫.২৬ টাকা, পরবর্তী ১২৫ ইউনিটের জন্য ৭.২০, পরবর্তী ১০০ ইউনিটের জন্য ৭.৫৯, পরবর্তী ১০০ ইউনিটের জন্য ৮.০২, পরবর্তী ২০০ ইউনিটের জন্য ১২.৬৭ ও পরবর্তী ৪০০ ইউনিটের জন্য ১৪.৬১ টাকা হারে বিদ্যুৎ বিল হবে। বিদ্যুৎ বিল বিভিন্ন ট্যারিফ রেট দ্বারা নির্ধারিত। এছাড়া ২০ কিলোওয়াটের ঊর্ধ্বের থ্রি ফেজ গ্রাহকদের পাওয়ার ফ্যাক্টর ০.৯৫-এর কম হলে বিধি অনুযায়ী পাওয়ার ফ্যাক্টর পেনাল্টি চার্জ দিতে হয়।

বিদ্যুৎ খাত সম্পর্কে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ধারণা খুব একটা ইতিবাচক নয়। তবে স্মার্ট বাংলাদেশে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে কাজ করে বিদ্যুৎ বিভাগ তাদের ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে পারে বলে মনে করে বিশেষজ্ঞদের। আপাতত প্রিপেইড মিটারের যে বেহাল দশা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে মানুষের বিশ্বাসের জায়গাটা আরো বেশি নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে বলে মত তাদের। একটা অন্ধকারের মাঝে থেকে মাসে দু-তিনবার বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করছেন তারা। এতে অসন্তোষের মাত্রা শুধু বাড়ছেই।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমানে জনগণের পক্ষে কথা বলার মতো লোক নেই। কোথাও অভিযোগ করে প্রতিকার পাওয়া যায় না। যেসব প্রতিষ্ঠান জনগণের সেবা নিশ্চিত করবে, জনগণের সেবা করবে তারাই জনগণকে নিপীড়ন করছে। তাদের জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই, কোথাও জবাব দিতে হয় না। রেগুলেটরি কমিশনগুলো নিষ্ক্রিয়। এ অবস্থায় এসব এখন জুলুমে পরিণত হয়েছে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close