প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২৪ মে, ২০২৪

টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে বাড়ছে ‘শঙ্কা’

দেশে শুধু ফাইজার দেওয়া হচ্ছে * পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না, খুঁজে দেখার নির্দেশ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর

করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যবহার হয়েছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা। ৩ বছর আগে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে বিশ্বে প্রথম করোনার টিকা প্রয়োগ শুরু হলেও এবার বিশ্বব্যাপী জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয় নিয়ে। ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে বাড়ছে নানা ধরনের শঙ্কা। সম্প্রতি ব্রিটেনের আদালতে ১০ কোটি পাউন্ড ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা হয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার বিরুদ্ধে। অভিযোগে বলা হয়েছে, অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা টিকা গ্রহণের কারণে গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগে বিশ্বজুড়ে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

বাংলাদেশে এ টিকাগ্রহীতার মধ্যে এখন পর্যন্ত গুরুতর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা না গেলেও আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে বিষয়টি। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, করোনা প্রতিরোধে অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা যৌথভাবে একই টিকা দুই জায়গায় উৎপাদন করে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি টিকার নাম দেওয়া হয় ‘কোভিশিল্ড’। ইউরোপে তৈরি টিকার নাম দেওয়া হয় ‘ভ্যাক্সজেভ্রিয়া’। কোভিশিল্ড টিকা বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে প্রয়োগ করা হয়। শুধু ভারতে এ টিকা দেওয়া হয়েছে অন্তত ১৭৫ কোটি ডোজ। বাংলাদেশে প্রয়োগ করা টিকার ডোজের ১৬ শতাংশ কোভিশিল্ডের টিকা।

২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রয়োগ করে সরকার। এরপর অন্য উৎস থেকেও অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পায় বাংলাদেশ। দেশে এখন পর্যন্ত ৫ কোটি ৬২ লাখ ৮০ হাজার ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে, যা প্রয়োগ করা টিকার ১৫.৬ শতাংশ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত করোনার আটটি টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে। এতে প্রথম থেকে চতুর্থ ডোজে ৩৬ কোটি ৬৮ লাখ ৭৫ হাজার টিকা পেয়েছেন বিভিন্ন বয়সি ১৩ কোটির বেশি মানুষ। গত ফেব্রুয়ারিতে এক নথিতে অ্যাস্ট্রাজেনেকা কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছিল, টিকা গ্রহণের পর ‘টিটিএস বা থ্রম্বোসিস উইথ থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া সিনড্রোম’ নামের এক ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। তবে তা খুবই বিরল।

বিবৃতিতে অ্যাস্ট্রাজেনেকার দাবি, ২০২০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ছাড়পত্র পাওয়ার পর পৃথিবীজুড়ে এক বছরে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৩০০ কোটি করোনা টিকার ডোজ ব্যবহার করা হয়েছে। এসব টিকার ডোজ প্রাণ বাঁচিয়েছে ৬৫ লাখেরও বেশি মানুষের। বিভিন্ন দেশের সরকার আমাদের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছে এবং করোনা মহামারি দূর করতে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তা বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু বর্তমানে মূল করোনা ভাইরাসটি প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ায় এবং এটি থেকে উদ্ভূত অন্য ভ্যারিয়েন্টগুলো দুর্বল হয়ে যাওয়ায় এসব টিকা এখন ব্যবহার হচ্ছে না। তাই বাজারে থাকা সব টিকা প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরই মধ্যে অংশীদারদের এ ব্যাপারে অবহিত করা হয়েছে।

টিটিএস বা থ্রম্বোসিস উইথ থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া সিনড্রোমের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) বলেছে, টিটিএস এমন একটি বিরল শারীরিক অবস্থা, যার ফলে শরীরের অস্বাভাবিক কোনো জায়গায় রক্ত জমাট বাঁধে। রক্তে প্লাটিলেটের সংখ্যা কমিয়ে দেয়। প্লাটিলেট রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। ফলে রক্তের এ উপাদান কমে গেলে মানুষের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে পারে। টিটিএসের ফলে মস্তিষ্ক বা অন্ত্রে, কখনো কখনো পা বা ফুসফুসেও রক্ত জমাট বাঁধায়। ফলে রক্তে প্লাটিলেট সংখ্যা প্রতি মাইক্রো লিটারে ১ লাখ ৫০ হাজারের নিচে নেমে যেতে পারে। টিটিএসের উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে গুরুতর মাথাব্যথা, পেটব্যথা, পায়ে ফোলাভাব, শ্বাসকষ্ট ও খিঁচুনির মতো সমস্যা।

যখন অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রয়োগ করা হয়, তখন বিকল্প কোনো টিকা ছিল না। পরে অনেক টিকাই পাওয়া গেছে। এসব টিকা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, জার্মানিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অনুমোদন দিয়েছে। আমরাও একই পরামর্শ দিয়েছিলাম। দেশে টিকার অনুদান ও প্রয়োগের বিষয়ে সরকারের পরামর্শক হিসেবে কাজ করে টিকাণ্ডসংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটি (বাংলাদেশের ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি গ্রুপস-নাইট্যাগ)। ২০২১ সালে যখন অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রয়োগ করা হয়, তখন নাইট্যাগের সদস্য ছিলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জরুরি পরিস্থিতিতে বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে টিকাটি দেশে অনুমোদনের জন্য নাইট্যাগ পরামর্শ দিয়েছিল। টিকাটি খুব অল্পসময়ে প্রস্তুত করা হয়েছিল। সাধারণত একটি টিকা প্রয়োগের পর্যায়ে যেতে ১০ থেকে ১২ বছর সময় লাগে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো বেশি সময় প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে যখন টিকাটির অনুমোদন দেওয়া হয়, তখন যুক্তরাজ্যেও অনুমোদিত হয়। এখন যে সমস্যার কথা বলা হচ্ছে, তা বাংলাদেশে হচ্ছে কি না, সেজন্য ক্লিনিক্যাল সার্ভের প্রয়োজন। আমরা ওই সময় সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, যাদের এ টিকা দেওয়া হবে তাদের যেন মনিটরিং করা হয়। এ পর্যবেক্ষণ স্বল্প ও দীর্ঘসময়ের হতে হবে। করোনার টিকার কারণে যদি মানুষের কোনো সমস্যা হয় এবং বিষয়টি যদি সঠিকভাবে পর্যালোচনা করা না হয়, তাহলে তা শনাক্ত করা যাবে না। এজন্য দীর্ঘদিন একটি নির্দিষ্টসংখ্যক মানুষকে টিকা দেওয়ার পর পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এক্ষেত্রে ডিজিডিএ ফার্মাকোভিজিল্যান্সের করণীয় রয়েছে।

বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা বিবেচনা করে দেশে ফাইজার ব্যতীত কোনো টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছে না বলে জানান নাইট্যাগ সভাপতি অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, ‘গত নভেম্বরে আমরা শুধু ফাইজারের টিকা প্রয়োগের কথা সরকারকে বলেছি। মর্ডানার টিকায় হৃদযন্ত্রে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ায় আমরা সেটিও বন্ধ করেছি। অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা যারা নিয়েছেন তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করতে বলা হয়। বিশেষ করে স্নায়বিক, হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের সমস্যাগ্রস্ত রোগীদের বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করতে আমরা চিকিৎসকদের পরামর্শ দিয়েছি।’

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. সালাহউদ্দিন বলেন, টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণের জন্য সেসময় জেলা, বিভাগ ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সেল করা হয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) ও ঔষধ প্রশাসন বিষয়টি পর্যালোচনা করে। সাধারণত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ২৪ ঘণ্টা বা ৪৮ ঘণ্টা অথবা তার কম সময়ের মধ্যে দেখা দেয়। এ কারণে টিকা দেওয়ার পরপরই টিকাগ্রহীতাকে কিছু সময় টিকা কেন্দ্রে রাখা হয়। টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়টি পর্যালোচনা করে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ফার্মাকোভিজিল্যান্স সেন্টার।

এ সেন্টারের প্রধান ও অধিদপ্তরের পরিচালক ড. মো. আকতার হোসেন বলেন, আমরা ওভারঅল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা অ্যাডভার্স ইভেন্ট ফলোইং ইমিউনাইজেশন (এইএফআই) দেখি। আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে সব জেলা-উপজেলার রিপোর্ট আসত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিষয়টি ভালো বলতে পারবে। টিকা অনুমোদনের বিষয়টি ডিজিডিএ দেখে। এরপর টিকার প্রয়োগ থেকে শুরু করে বাকি সব বিষয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে। আমরা ফার্মাকোভিজিল্যান্সে সার্বিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (মাতৃ, শিশু ও কৈশোর স্বাস্থ্য এবং সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি-ইপিআই) ডা. মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন বলেন, আমরা এখন অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দিচ্ছি না। টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়টি সারা দেশে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এ টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়টি শুনেছি। তবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এমন কোনো ঘটনা পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে কাজ করার জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি রয়েছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড টিকা গ্রহণের কারণে বাংলাদেশে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে কি না, তা খুঁজে দেখতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা টিকা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। কয়েকটি দেশে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে বলেও জানা গেছে। আমরাও যেহেতু অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা গ্রহণ করেছি, এখন আমাদের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে কি না, তা খুঁজে দেখতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close