নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৩ মে, ২০২৪

রহস্যময় আনোয়ারুল আজিম

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। কয়েকদিন আগে চিকিৎসার জন্য ভারত গিয়েছিলেন। এরপর থেকেই নিখোঁজ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিধাননগরের নিউটাউন এলাকার সঞ্জিভা গার্ডেন থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। গতকাল বুধবার এ ঘটনায় দুজনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কলকাতার বাংলাদেশ উপদূতাবাস সূত্র।

এমপি আনারের মরদেহ উদ্ধারের পর থেকেই শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্যের নিহতের ঘটনা নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্নও। তবে সব প্রশ্নের ভিড়ে একটি বিষয় সবাই জানতে চায়। কে এই এমপি আজিম? তাকে ঘিরে এত আলোচনার কারণ? আসলে কে ছিলেন এই আনার? ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের মধুগঞ্জ বাজার এলাকায় আনোয়ারুল আজিম আনারের পৈতৃক বাড়ি। তিনি কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে টানা তিনবার আওয়ামী লীগ থেকে তিনি এমপি নির্বাচিত হন।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, একসময়ের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থিদের নিয়ন্ত্রণ করতেন আনার। অস্ত্র ও বিস্ফোরকদ্রব্য পাচারের হোতা হিসেবেও পুলিশের খাতায় নাম ছিল তার। দীর্ঘদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও চরমপন্থিদের গডফাদার হিসেবে পরিচিতি পান। আনারের বিরুদ্ধে অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদকদ্রব্য ও স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি এবং চরমপন্থিদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে ৯টিরও বেশি মামলা ছিল। ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড আসামি হিসেবে পুলিশ একবার তাকে আটক করলেও তার ক্যাডাররা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে তাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলাও করে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যৌথ বাহিনীর অপারেশনের সময় আত্মগোপনে ছিলেন আনার।

ঝিনাইদহের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৮৬ সালের দিকে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থাকাকালে আনার মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন। ভারতের বাগদা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের বাঘাভাঙ্গা সীমান্তপথে চোরাচালান করতেন তিনি। ওইসময় কালীগঞ্জ থানাসহ মহেশপুর, কোটচাঁদপুর ও চুয়াডাঙ্গার জীবননগর থানা পুলিশের সঙ্গে মাসিক চুক্তিতে ‘টোকেন’ তৈরি করে তার বাহিনী। ওই টোকেন দেখালেই প্রশাসনের লোকজন মাদকদ্রব্য বহনকারী গাড়ি ছেড়ে দিত। এ টোকেন-বাণিজ্য থেকে আনার দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের মাদকসম্রাট হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।

এ মাদক কারবারের মাধ্যমে বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক বনেও যান তিনি। ১৯৯১ সালে আনার ঝিনাইদহের আরেক চোরাকারবারি পরিতোষ ঠাকুরের সঙ্গে মিলে স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। স্বর্ণের বড় বড় চালান রাজধানী থেকে বাঘাডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে প্রতিবেশী দেশে পাচার করতেন তারা। ১৯৯৬ সালে আনার বিএনপি থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগ দেন। মাদক-স্বর্ণ চোরাচালান কারবারের সঙ্গে কালীগঞ্জ পৌরসভার এক কমিশনারের হাত ধরে অস্ত্র চোরাকারবারে জড়ান তিনি। তার অবৈধ অস্ত্রের চালান চরমপন্থি ক্যাডার সামসেল ওরফে রবিনের কাছে বিক্রি হতো।

সূত্র বলছে, সরকারের পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ ভারতে আত্মগোপনের পর তার মাধ্যমে অস্ত্র চোরাকারবার চালিয়ে যান আনার। বাগদা এলাকার মাদকসম্রাট জয়ন্ত কুমার, কার্তিক, গৌতম সাহা ও বনগাঁর দেবদাসের সঙ্গে আনারের মাদকের কারবার ছিল। ২০০৭ সালে চুয়াডাঙ্গার লোকনাথপুর এলাকা থেকে ১২ কেজি ৯৫০ গ্রাম স্বর্ণ আটক করে তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর। চোরাকারবারিরা নিশ্চিত হয়, দর্শনা শ্যামপুরের সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম স্বর্ণগুলো ধরিয়ে দিয়েছে। ওই ঘটনায় টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন সাইফুল। তিনি নিজেও স্বর্ণ চোরাকারবারিদের সিন্ডিকেটে যুক্ত ছিলেন। ওই হত্যা মামলায় আনারসহ আসামি করা হয় ২৫ জনকে। কুষ্টিয়ার চরমপন্থি নেতা মুকুল, শাহীন রুমী, ঝিনাইদহের চোরাকারবারি পরিতোষ ঠাকুর, আনারসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে পরের বছর আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

২০১২ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিতোষ, আনারসহ বেশ কয়েকজন মামলা থেকে অব্যাহতি পান। এ মামলায় আনারকে গ্রেপ্তারে ২০০৯ সালে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন চুয়াডাঙ্গার বিশেষ আদালত। এর ১০ দিন পর ওই বছরের ২১ জানুয়ারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তারের জন্য নিশ্চিন্তপুর গ্রামে তার বাড়িতে অভিযান চালালেও তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ধীরে ধীরে আনারের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো কমে যেতে শুরু করে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হলে ক্ষমতার দাপটে বেশিরভাগ মামলা থেকে নিজেকে মুক্ত করেন আনার।

নিহত আনারের লাশ নিয়ে গণমাধ্যমে একটা ধোঁয়াশা থাকলেও কলকাতা বিধাননগর পুলিশের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার মানব শ্রিংলা বলেন, ক্যাবচালক স্বীকারোক্তি দিয়েছেন ১৩ মে যে ব্যক্তিকে তিনি গাড়িতে তুলেছিলেন, তাকে হত্যার পর টুকরো টুকরো করে লাশ ছড়িয়ে দিয়েছে। মূলত নিখোঁজের অভিযোগ পাওয়ার পর এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দুজনকে আটক করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তারাই জানান, লাশ আছে সঞ্জিভা গার্ডেনে। সে খবর দেওয়া হয় কলকাতা পুলিশকে। পরে বুধবার এ লাশ উদ্ধার করে ভারতের পুলিশ। যে ফ্ল্যাট থেকে আনোয়ারুল আজিম আনারের খণ্ড-বিখণ্ড লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, তার মালিকও একজন বাংলাদেশি। তিনি ভারতে গিয়ে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে ওই ফ্ল্যাট কিনেছেন। কলকাতার পুলিশ তাকেও খুঁজছে বলে জানানো হয়েছে।

পুলিশের কর্মকর্তারা বলেন, যে ফ্ল্যাটে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে; সেটি পুলিশ ঘিরে রেখেছে। সেখানে কাউকে এখনো ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। পুলিশের সূত্র বলেছে, ওই ফ্ল্যাটে তিনজনকে ঢুকতে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে একজন নারী। তবে ওই তিনজনকে সেখান থেকে বের হতে আর দেখা যায়নি। প্রসঙ্গত, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টিভি নাইন বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১২ মে কলকাতায় যান আনার। একজন অফিসারের ফ্ল্যাটে উঠেছিলেন তিনি। তার সঙ্গে আরো তিনজন ছিলেন। বরানগর এলাকার সিঁথিতে যে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলেন আজিম তার নাম গোপাল বিশ্বাস। গত ১৩ মে দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভাড়া করা গাড়িতে ওঠেন আজিম। তারপর থেকেই তিনি নিখোঁজ ছিলেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close