প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২৩ মে, ২০২৪

কলকাতায় এমপি আজিম খুন!

ভারতে চিকিৎসার জন্য গিয়ে খুন হয়েছেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম। তবে এখনো তার মরদেহই উদ্ধার হয়নি। শুধু রক্তের দাগ মিলেছে। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা সেখান থেকে আঙুলের ছাপ এবং রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। তবে কিছু প্রমাণের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মনে করছে, তাকে হত্যা করা হয়েছে। সংস্থাটির প্রধান অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, ‘আমরা কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছি, যার ভিত্তিতে মনে করা হচ্ছে, ওনাকে হত্যা করা হয়েছে।’ খবর এনডিটিভি, বিবিসি বাংলা ও আনন্দবাজার পত্রিকার।

গত ১২ মে এমপি আজিম দর্শনা-গেদে সীমান্ত দিয়ে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যান। সেখানে পৌঁছে তিনি ওঠেন তার বন্ধু বরাহনগরের স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে। ১৩ মে দুপুরে সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি। পরে আজিমের খোঁজে তল্লাশি শুরু করে কলকাতা পুলিশ। এ বিষয়ে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, যতটুকু তথ্য পেয়েছি, তাতে আজিমকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। ভারতের পুলিশ আমাদের যে তথ্য দিয়েছে, সে তথ্যানুযায়ী যারা খুন করেছে বা খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, আমরা যাদের সন্দেহ করছি, তাদের মধ্য থেকে তিনজনকে পুলিশ ধরেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, এমপি আজিমের হত্যাকাণ্ড দুঃখজনক ও মর্মান্তিক। কলকাতা পুলিশ যে ফ্ল্যাটে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছে, সেখানে লাশ খুঁজে পায়নি। তবে হত্যাকাণ্ডের পর কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। ডিবি আটক করেছে, কলকাতা পুলিশও দুজনকে আটক করেছে। কীভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে, সে ব্যাপারে তদন্ত চলছে। এ ঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, এটি একটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। এটি পারিবারিক, আর্থিক নাকি এলাকার কোনো দুর্বৃত্তকে দমন করার জন্য হয়েছে, তা আমরা তদন্ত করে দেখছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে কাজ করছি।

সর্বশেষ বুধবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির আইজি অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, আজিম ব্যক্তিগত সফরে এসে এখান থেকে নিখোঁজ হয়ে যান। ১৮ মে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারের কাছে একটি নিখোঁজ ডায়েরি করা হয়। এমপি পরিচিত গোপাল বিশ্বাস এ অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করি। এ ঘটনা তদন্তে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারের একটি তদন্তকারী দল গঠন করা হয়। এরপর গত ২০ মে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে এ কেসটিকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করার একটি নির্দেশ আসে। চতুর্বেদী বলেন, আজ (বুধবার) তথ্য আসে, তাকে খুন করা হয়ে থাকতে পারে। এরপর পুলিশ ফ্ল্যাটটি শনাক্তকরণ করে। কারণ এখানেই তাকে শেষবার দেখা গিয়েছিল। আমাদের কাছে যা তথ্য আছে, তাতে এমপি ১৩ তারিখে এ আবাসনে ঢুকেছিলেন। তবে এর আগে এসেছিলেন কি না, সেটি পরিষ্কার নয়। তার সঙ্গে আরো কয়েকজন ছিলেন সেই বিষয়টিও তদন্তসাপেক্ষ।

এমপি আজিমের শরীর টুকরো টুকরো করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে তার সত্যতা কতুটুকু, এ প্রশ্নের জবাবে চতুর্বেধী বলেন, এটা এখনই বলা সম্ভব নয়। টিম ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ফটোগ্রাফিসহ সবাইকে এ তদন্ত করতে বলা হয়েছে। তারা খতিয়ে দেখছেন। তবে আমরা কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছি, যার ভিত্তিতে মনে করা হচ্ছে, ওনাকে হত্যা করা হয়েছে। চতুর্বেদী জানান, যে প্লটটিতে ওই এমপি উঠেছিলেন সেটি সন্দীপ রায়ের নামে এক ব্যক্তির। তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আবগারি দপ্তরে কাজ করেন। তিনি ভাড়া দিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (প্রবাসী বাংলাদেশি) বাসিন্দা আখতারুজ্জামান নামে এক ব্যক্তিকে।

এদিকে আজিমের খোঁজ চেয়ে বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেছেন তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। মামলার এজাহারে ডরিন বলেন, গত ৯ মে রাত ৮টায় ন্যাম ভবনের বাসা থেকে আজিম তার গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের উদ্দেশে বের হন। গত ১১ মে বিকেল পৌনে ৫টায় ভিডিও কলে কথা বলার সময় তার কথাবার্তা অসংলগ্ন মনে হয়। এরপর একাধিকবার ফোন করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ডরিন লিখেছেন, “গত ১৩ মে বাবার ইন্ডিয়ান সিম নম্বর +৯১৭০৬৩২১৪৫৬৯ থেকে উজির মামার হোয়াটসআপ নম্বরে একটি ম্যাসেজ আসে, ‘আমি হঠাৎ করে দিল্লি যাচ্ছি, আমার সঙ্গে ভিআইপি আছে। আমাকে ফোন দেওয়ার দরকার নাই। আমি পরে ফোন দেব।’ এটা ছাড়াও আরো কয়েকটি মেসেজ আসে। সেই মেসেজগুলো আমার বাবার মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অপহরণকারীরা করে থাকতে পারে।”

এজাহারে আরো লেখা হয়েছে, ‘আমরা বিভিন্ন জায়গায় আমার বাবার খোঁজখবর করতে থাকি। আমার বাবার কোনো সন্ধান না পেয়ে আমার বাবার বন্ধু শ্রী গোপাল বিশ্বাস ইন্ডিয়ার বারানগর পুলিশ স্টেশনে গত ১৮ মে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। বাবাকে খোঁজাখুঁজি অব্যাহত রাখি। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে পারি- অজ্ঞাত ব্যক্তিরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজশে বাবাকে অপহরণ করেছে।’ এদিকে কলকাতা পুলিশের বরাতে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার এক ক্যাবচালক জানিয়েছেন, এক সপ্তাহ আগে নিখোঁজ আজিমকে হত্যা করা হয়েছে এবং মরদেহ খণ্ড-বিখণ্ড করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

কলকাতা বিধাননগর পুলিশের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার মানব শ্রিংলা বলেন, ক্যাবচালক স্বীকারোক্তি দিয়েছেন- ১৩ মে যে ব্যক্তিকে তিনি গাড়িতে তুলেছিলেন, তাকে হত্যার পর টুকরো টুকরো করে লাশ ছড়িয়ে দিয়েছেন। পুলিশের কর্মকর্তারা বলেন, যে ফ্ল্যাটে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, সেটি পুলিশ ঘিরে রেখেছে। সেখানে কাউকে এখনো ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ওই ফ্ল্যাটে তিনজনকে ঢুকতে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে একজন নারী। তবে ওই তিনজনকে সেখান থেকে বের হতে আর দেখা যায়নি।

এর আগে ২০ মে আজিমের খোঁজ করতে গিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তার মোবাইল লোকেশন ট্র্যাক করে। তারা জানতে পারে, কলকাতায় বন্ধুর বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তার মোবাইলের লোকেশন একবার পাওয়া গিয়েছিল সেখানকার নিউমার্কেট এলাকায়। এরপর ১৭ মে তার ফোন কিছুক্ষণের জন্য সচল ছিল বিহারের কোনো জায়গায়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে কলকাতায় বাংলাদেশ উপদূতাবাস কর্তৃপক্ষ এ তথ্য পেয়েছে বলে বাংলাদেশি উপদূতাবাসের এক কর্মকর্তা জানান।

আজিমের বন্ধু গোপাল বিশ্বাস বলেন, ১৩ মে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যে ভাড়া করা গাড়িতে উঠেছিলেন আজিম, সেটির চালকের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ওই চালক পুলিশকে জানান, সংসদ সদস্যের সঙ্গে এক বাংলাদেশি নাগরিক ছিলেন। তাদের দুজনকে তিনি কলকাতাসংলগ্ন নিউটাউন এলাকায় ছেড়ে দেন ১৩ মে। কলকাতার সিঁথি অঞ্চলের বাসিন্দা ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের সঙ্গে আজিমের দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সম্পর্ক। গোপালের বাড়ি মাঝদিয়ায়। বিএনপির জমানায় সুভাষ আগারওয়ালের বাড়িতে থাকতেন আজিম। সেখানেই গোপালের সঙ্গে পরিচয়, তারপর বন্ধুত্ব। সম্পর্কটা এখন পারিবারিক। সে কারণেই চিকিৎসা করাতে এসে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলেন আজিম।

গোপাল বিশ্বাস বলেন, আজিম এসে আমাকে বলেছিলেন, স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাবেন। কোন ডাক্তার ভালো হবে, সেটাও জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার জানাশুনা স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ নেই, তাই তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম- সল্ট লেকের অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে পারেন। আমরা একসঙ্গে সকালের জলখাবার খেয়েছিলাম। তারপর এটাও তাকে বলেছিলাম, আমার গাড়ি সেদিন নেই। তিনি যেন গাড়ির বন্দোবস্ত করে নেন। এরপর আমি বাড়ির একতলায় অফিসে চলে আসি। পরে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। দুপুরে বের হওয়ার সময় আমাকে বলে যান, তিনি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরবেন। তার খোঁজ না পাওয়ার পর যখন সিসিটিভি ফুটেজ দেখি, তখন জানতে পারি- তিনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে। সন্ধ্যায় বন্ধুর বাড়িতে ফিরে আসার কথা থাকলেও সেখানে ফেরেননি আজিম। হোয়াটসঅ্যাপে ১৩ মে তিনি মেসেজ পাঠান, ‘বিশেষ কাজে দিল্লি চলে যাচ্ছি এবং পৌঁছে ফোন করব, তোমাদের ফোন করার দরকার নেই।’

এরপর ১৫ মে সকালে গোপাল আজিমের কাছ থেকে আবারও একটি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ পান, তিনি দিল্লি পৌঁছেছেন এবং তার সঙ্গে ‘ভিআইপিরা’ আছেন, তাই তাকে যেন ফোন না করা হয়। এর দুদিন পর ১৭ মে গোপালকে আজিমের মেয়ে ফোন করে জানান, তার বাবার সঙ্গে তারা যোগাযোগ করতে পারছেন না। সে খবর জানতে পেরে কলকাতায় ওর যত ঘনিষ্ঠ মানুষ আছে বলে জানি, সবাইকে বিষয়টা জানাই। তারাও খোঁজখবর করতে শুরু করেন। কিন্তু কোনোভাবেই আজিমকে ফোনে পাওয়া যায়নি। পরদিন ১৮ মে বরাহনগর থানায় যান তিনি। গোপাল বলেন, সেখানে আমাকে সারা দিন বসিয়ে রাখা হয়। পুলিশ আমার বাড়িতে গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। সেসব খতিয়ে দেখে আমার নিখোঁজ ডায়েরি নেওয়া হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close