প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২২ মে, ২০২৪

ইরান ট্র্যাজেডি

দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত হত্যা!

* হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যু * সন্দেহের তির ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের দিকে

ইরানে মর্মান্তিক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। প্রাণ হারিয়েছেন তার সফরসঙ্গী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ানসহ ঊর্ধ্বতন আরো কয়েকজন কর্মকর্তা। রবিবার ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ পূর্ব আজারবাইজানে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। ইরানি কর্তৃপক্ষ বরাবরই দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বৃষ্টি-কুয়াশাসহ বৈরী আবহাওয়ার কথা বললেও কোনো কোনো মহল বলছেন, এটি নিছকই দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কেননা, চিরশত্রু ইসরায়েলের অতীত রেকর্ড রয়েছে, সুযোগ পেলেই ইরানি স্বার্থে হামলা ও কর্মকর্তাদের হত্যা করা। শুধু ইসরায়েলই নয়, ইরানের চিরশত্রু যুক্তরাষ্ট্রেরও হাত থাকতে পারে এই দুর্ঘটনায়। খবর আলজাজিরা, টাইমস অব ইসরায়েল, ইকোনোমিক টাইমস ও রয়টার্সের।

ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার রবিবার সন্ধ্যায় দুর্ঘটনার কবলে পড়লেও পরদিন সকালে প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে ইরান। উদ্ধারকারীরা এদিন প্রেসিডেন্ট রাইসিসহ দুর্ঘটনায় নিহতদের মরদেহ উদ্ধার করে।

হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের কারণ হিসেবে ইরানের সরকারি ভাষ্য বলছে, সীমান্তবর্তী ওই পাহাড়ি এলাকায় বৃষ্টি ও কুয়াশাসহ বৈরী আবহাওয়ার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে গুঞ্জনও উঠেছে, এটি নাশকতাও হতে পারে। ইরানের ভেতরে-বাইরে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে থাকা রাইসির এমন মৃত্যুর নেপথ্যে দেশীয় প্রতিপক্ষ কিংবা ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাইরের শত্রুরাও জড়িত থাকতে পারে।

পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড কি না- সন্দেহ ইসরায়েলকে : দীর্ঘ সাড়ে সাত মাস ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় সশস্ত্র সংগঠন হামাসকে উৎখাতে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। পাশাপাশি লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধেও চালাচ্ছে হামলা। হামাস ও হিজবুল্লাহ উভয়কেই পৃষ্ঠপোষকরা দিয়ে থাকে ইরান।

দুর্ঘটনার পর আন্তর্জাতিক সাপ্তাহিক ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের বিমান হামলায় সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের একজন জেনারেলকে হত্যা এবং পরবর্তী সময়ে ইসরায়েলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলাসহ দুই দেশের মধ্যকার সাম্প্রতিক উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে রাইসি মৃত্যুর নেপথ্যে ইসরায়েলের হাত থাকতে পারে।

রাইসির দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘিরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এমন জল্পনা শুরুর পরপরই এ ধরনের দাবি নাকচ করে দিয়েছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর ঘটনায় ইসরায়েলের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমরা এর সঙ্গে জড়িত নই।’

বিশেষজ্ঞরাও রাইসির মৃত্যুর পেছনে ইসরায়েলের হাত থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছেন না। স্থানীয় গণমাধ্যমকে ইসরায়েলের নেতা আভিগদর লিবারম্যান বলেন, রাইসির মৃত্যুর পর মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে- ইসরায়েল এমন আশা করে না। আমাদের জন্য রাইসির মৃত্যু কোনো বিষয় নয়।’

সন্দেহের তির যুক্তরাষ্ট্রের দিকেও : সন্দেহের আঙুল উঠছে যুক্তরাষ্ট্রের দিকেও। ইরানের জেনারেল কাশেম সোলাইমানির মতো প্রভাবশালী নেতাকে হত্যা করার ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাছাড়া বারবার হুঁশিয়ারি দিয়েও ইরানকে পরমাণু কর্মসূচি থেকে ফেরাতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে একমাত্র ইরানের কারণেই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে প্রভাব কমেছে ওয়াশিংটনের। সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের চরম শত্রু চীন। রাশিয়ার সঙ্গেও রাজনৈতিক সখ্যতাও গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে ইরানের। এসব কারণেও রাইসি যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন কি না, সেই সেই শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

ইরান এরই মধ্যে অভিযোগ তুলেছে, রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার কবলে পড়ার খবর আসার পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে উদ্ধার অভিযানে সহায়তা চেয়েছিল তেহরান। তবে সেই সহায়তার আহ্বানে এগিয়ে আসেনি যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি বিশ্ব রাইসির মৃত্যুতে শোক জানালেও হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার খবরে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়তে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর রিক স্কটকে। তিনি গণমাধ্যমে বলেন, রাইসিকে ভালোবাসা বা সম্মান নয়, কেউ তাকে মিসও করবে না। যদি তিনি মারা যান, আমি সত্যিই আশা করি ইরানি জনগণ তাদের দেশকে খুনি স্বৈরশাসকের হাত থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবে।

রাইসির শোকসভায় লাখো মানুষের ঢল : মর্মান্তিক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির শোকসভায় ঢল নেমেছে লাখো শোকার্ত জনতার। গতকাল মঙ্গলবার সকালে ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের তাবরিজ শহরে প্রথম জানাজা ও বিকেলে কোম শহরে দ্বিতীয় জানাজা হয়েছে। আজ বুধবার প্রেসিডেন্ট রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ানসহ অন্যদের মরদেহ নেওয়া হবে তেহরানে।

উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ পূর্ব আজারবাইজানের পাহাড়ি এলাকায় রবিবার বৃষ্টি ও কুয়াশাসহ বৈরী আবহাওয়ায় হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান, আজারবাইজান প্রদেশের গভর্নর মালিক রহমতি ও তাবরিজের ইমাম আয়াতুল্লাহ আলী হাশিমসহ অন্তত ৯ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এ ঘটনায় দেশটিতে চলছে পাঁচ দিনের জাতীয় শোক। লাখো ইরানি নাগরিক গতকাল মঙ্গলবার তাবরিজে রাইসিসহ তার সাত সহযোগীর মরদেহ নিয়ে শোকর‌্যালিতে অংশ নেন। তাবরিজের সেন্ট্রাল স্কয়ারে শোকর‌্যালিতে হেঁটেই চলেন তারা। এ সময় তাদের হাতে ছিল ছোট ছোট জাতীয় পতাকা এবং প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ছবি।

ইরান সরকার প্রেসিডেন্ট রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমিরসহ নিহতদের একাধিক জানাজার আয়োজন করেছে। মঙ্গলবার দুুপুরে তাবরিজে অনুষ্ঠিত হয় তাদের প্রথম জানাজা। এতে অন্যদের মধ্যে অংশ নেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমদ ওয়াহিদি। শোক সমাবেশ লাইভ সম্প্রচার করে ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভি। শোক সমাবেশে দেওয়া বক্তৃতায় ইরানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াহিদি বলেন, প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যু আমাদের জন্য বিশাল ক্ষতি। তবে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির শক্ত নেতৃত্বে আমরা প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর ক্ষতি শিগগির কাটিয়ে উঠব।

আজ ইরানে জানাজা ও স্মরণসভা : ইরানের এক্সিকিউটিভ অ্যাফেয়ার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহসেন মনসুরি জানান, তাবরিজ শহরে প্রথম জানাজার পর রাইসির মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় প্রদেশের আরেক শহর কোমে। সেখানে বিকাল সাড়ে ৪টায় প্রেসিডেন্ট রাইসি ও অন্যদের দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

মনসুরি জানান, কোম শহর থেকে মৃতদেহগুলো রাজধানী তেহরানে নেওয়া হবে। ইউনিভার্সিটি অব তেহরানে আজ বুধবার সকালে একটি জানাজা হবে। তেহরানের জানাজায় অংশ নেবেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। এরপর বিকেলে উচ্চপদস্থ বিদেশি কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে একটি স্মরণসভা হবে।

মনসুরি আরো জানান, প্রয়াত প্রেসিডেন্টের মরদেহ বৃহস্পতিবার সকালে নেওয়া হবে দক্ষিণ খোরাসান প্রদেশের রাজধানী বিরজান্দে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় খোরাসানের শহর মাশহাদে শিয়া ইমাম রেজার মাজারে প্রেসিডেন্ট রাইসির দাফন সম্পন্ন হবে।

নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২৮ জুন : প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুতে শোকের মধ্যেই দেশটিতে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে ইরান। আগামী ২৮ জুন এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির অন্তর্বর্তীকালীন কাউন্সিল।

ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর পরবর্তী ৫০ দিনের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্টের অধীনে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে। সোমবারই দেশের অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী বাঘেরি কানি।

গতকাল মঙ্গলবার দেশটির গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে জানানো হয়, প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুতে ইরান ঘোষণা করেছে, আগামী ২৮ জুন আগাম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইরানের গার্ডিয়ান কাউন্সিলের বৈঠকে সোমবার দেশটির ১৪তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। দেশের বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভার প্রধানদের নিয়ে ওই কাউন্সিল গঠিত।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থীদের নিবন্ধন শুরু হবে আগামী ৩০ মে এবং ১২ জুন থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত প্রচার চালাতে পারবেন প্রার্থীরা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close