অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

  ১৭ মে, ২০২৪

সুদহারে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফের হস্তক্ষেপ

বাজারভিত্তিক সুদহার ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যে পিছুটান

মাত্র এক সপ্তাহ আগেই সুদহার বাজারভিত্তিক হবে বলে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপকালে সুদহারে ফের হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এমনকি সাড়ে ১৪ শতাংশের ওপরে সুদহার যাবে না বলেও ব্যবসায়ীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। গতকাল বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক শেষে এসব কথা জানান ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুব আলম।

ব্যাংক ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করার এক সপ্তাহ পরই পরোক্ষভাবে সেখানে হস্তক্ষেপ করার ইঙ্গিত দিলেন গভর্নর। সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশের ওপরে ঋণের সুদহার যাবে না বলে এফবিসিসিআইকে নিশ্চিত করেছেন আবদুর রউফ তালুকদার। তিনি বলেন, একটা প্রজেক্ট করার সময় সুদহার, বিনিময়হারসহ নানাবিধ চিন্তাভাবনা করে তারপর কাজ শুরু করি। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছুদিন পরই যদি নীতিতে পরিবর্তন আনে, তখন আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হই। অবশ্যই বারবার নীতি পরিবর্তন হলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক। এজন্য আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অনুরোধ করেছি, যাতে নীতিগুলো বারবার পরিবর্তন না করে। যাতে নীতিগুলো দীর্ঘমেয়াদি হয়। এতে আমাদের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা করতে সহজ হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গর্ভনর এ বিষয়ে আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন।

তিনি বলেন, সুদহার বাজারভিত্তিক করা হলেও এটাকে ১৪ শতাংশের ওপরে যেতে দেওয়া হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন গভর্নর। যাতে ব্যবসায়ীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হন, তেমন ব্যবস্থা নেওয়া হবে ভবিষ্যতে। আমি মনে করি, দেশের মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির সঙ্গে সুদহারের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি আরো বলেন, ডলারের দাম একসঙ্গে ৭ টাকার বাড়ার কারণে যে পরিমাণ ঋণ বেড়েছে, সে পরিমাণ টাকার দীর্ঘমেয়াদি ঋণের আবেদন করেছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ ডলারের দাম বাড়ার কারণে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া যাদের ঋণে একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম করেছে, তাদের জন্য বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানান গভর্নর। ডিসেম্বরের মধ্যে ডলার মার্কেট স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলেও জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ এ কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আমরা ডলারের অভাবে এলসি খুলতে পারছি না। এদিকে ইডিএফ কমিয়ে ৩ বিলিয়নে নামিয়ে আনা হয়েছে। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এ সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিকল্প একটি তহবিল ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া এখন ব্যবসায়ীরা ১১৭ টাকায় এলসি খুলতে পারছেন কি না; এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যদি কোনো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বেশি টাকা নেওয়া হয়, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভিযোগ করতে বলা হয়েছে। তাহলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তিনি আরো বলেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে কিছু কিছু গ্রাহকের একক গ্রহণ সীমা অতিক্রম করেছে। বিষয়টি সমাধানে ব্যাংক এবং গ্রাহকভিত্তিক বিশেষ সুবিধা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন গভর্নর। ফান্ডেড এবং নন-ফান্ডেড মিলে ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ একজন গ্রাহক না পাওয়ার শর্ত থাকলেও এ পরিস্থিতিতে তাদের জন্য বিশেষ বিবেচনা করা হবে।

প্রসঙ্গত, গত ৮ মে ব্যাংক ঋণের সুদহার নির্ধারণ পদ্ধতি সিক্স মান্থ মুভিং অ্যাভারেজ রেট (স্মার্ট) প্রত্যাহার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হবে। ঋণের সুদহার সম্পূর্ণরূপে বাজারভিত্তিক করার জন্য ৬ মাসের ট্রেজারি বিলের গড় সুদভিত্তিক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এ-সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কিন্তু এখন এ নির্দেশনা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পিছু হটছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ধারণা করা হচ্ছে, আইএমএফের কারণে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি।

এদিকে বুধবার এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, যেসব গ্রাহকের নির্ধারিত একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম করেছিল, তাদের ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ঋণ নির্ধারিত সীমার মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এরপরও কিছু গ্রাহক একক গ্রাহক ঋণের ঊর্ধ্বসীমা শিথিল করার জন্য আবেদন করছেন, যা নির্দেশনার পরিপন্থি। এমন প্রেক্ষাপটে বৃহৎ ঋণঝুঁকি হ্রাস, করপোরেট সুশাসন সমুন্নত রাখা এবং ঋণ বিতরণে উত্তম চর্চা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য একক গ্রাহক ঋণসীমা কোনোক্রমেই অতিক্রম না করার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে সেই নির্দেশনা যথাযথ বাস্তবায়ন করবেন না বলে জানান গভর্নর।

এ সময় তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি এস এম মান্নান কচি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার দিয়েছে অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং বিনিয়োগ অঞ্চল ছাড়া কোথাও ব্যাংকগুলো বড় বিনিয়োগ করতে পারবে না। আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা না করে এবং আমাদের না জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের সার্কুলার দিয়েছে। এরই মধ্যে অনেকেই শত শত কোটি টাকা বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছে। তাই এ বিষয়টি বিবেচনা করে এ সার্কুলার প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করেছি।

আর এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক অঞ্চল যেগুলো করেছে, সেগুলো চালু হয়নি। আবার কিছু কিছু এরিয়ায় এখনো ঠিক করা সম্ভব হয়নি। তার আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার বাইরে বিনিয়োগ করতে নিষেধ করে প্রজ্ঞাপন দিয়েছে। এরিয়া ঠিক করার আগেই এ ধরনের প্রজ্ঞাপন দেওয়া ঠিক হয়নি। তাছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় তো আর ছোট ব্যবসায়ীরা যেতে পারবেন না। তাদের তো অত বেশি বিনিয়োগ করার সক্ষমতা নেই। তাহলে তারা কীভাবে বিনিয়োগ করবেন, কোথায় বিনিয়োগ করবেন, তার একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা দরকার। কিন্তু এসব পরিকল্পনা ছাড়াই প্রজ্ঞাপন দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close