আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৪৪তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আজ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দীর্ঘ নির্বাসন জীবন শেষে তিনি বাংলার মাটিতে ফিরে আসেন। এদিন বিকেল সাড়ে ৪টায় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের একটি বিমানে তিনি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে তৎকালীন ঢাকা কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান।

মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধার এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর যখন প্রবঞ্চক বিশ্বাসঘাতক খুনি দেশদ্রোহীরা প্রিয় মাতৃভূমিকে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলেছিল, আমাদের জাতীয় জীবন যখন জাতিদ্রোহীদের অত্যাচারের প্রচণ্ড দাবদাহে বিপর্যস্ত, তখন শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল শ্রাবণের বারিধারার মতো পাহাড়সমান বাধা জয়ের অনন্ত অনুপ্রেরণা। সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যার ফিরে আসায় অশ্রুসিক্ত জন্মভূমিতে সংকটজয়ের বীজ রোপিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিনির্মাণের দৃঢ় প্রত্যয়ে উদ্ভাসিত হয়েছিল বাঙালি জাতি। শুরু হয়েছিল গণতন্ত্র ফেরানোর যাত্রা।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখতে সেদিন সারা দেশের মানুষের গন্তব্য ছিল ঢাকা। স্বাধীনতার অমর সেøাগান ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে কেঁপে উঠেছিল বাংলার আকাশ-বাতাস। জনতার কণ্ঠে বজ্রনিনাদে ঘোষিত হয়েছিল ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম পিতৃহত্যার বদলা নেব’; ‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে আমরা আছি তোমার সাথে’। ‘শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’।

এদিকে, দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন, শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে অনন্য মাইলফলক। তার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। তিনি বলেন, নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং জনকল্যাণমুখী কার্যক্রমে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।

রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন এ উপলক্ষে শেখ হাসিনাকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে দেশে প্রত্যাবর্তন করে ‘আমাদের সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখিয়েছেন’ আর তারই সুযোগ্য উত্তরসূরি গণতন্ত্রের মানসকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করে তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন।

সেদিনের ঘটনা : বিকেল সাড়ে ৪টায় আকাশে যখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি দেখা যায়, তখন সব নিয়ন্ত্রণ আর অনুরোধ-আবেদন অগ্রাহ্য করে হাজার হাজার মানুষ বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকে যায়। অনেকটা ঝুঁঁকি নিয়েই বিমানটি অবতরণ করে। জনতা একেবারেই বিমানের কাছে চলে যায়। বহু চেষ্টার পর জনস্রোতকে কিছুটা সরিয়ে ট্রাকটি ককপিটের দরজার সামনে নেওয়া হয়। এই সময় শেখ হাসিনা ভেতর থেকে জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন। বেলা ৪টা ৩২ মিনিটে শেখ হাসিনা বিমানের সিঁড়ি বেয়ে ট্রাকে নেমে আসেন। কুর্মিটোলা থেকে শেখ হাসিনার শেরেবাংলা নগরে এসে পৌঁছতে সময় লাগে ৩ ঘণ্টা। এই সময় ঝড়-বৃষ্টিতে নগরজীবন প্রায় বিপন্ন। রাস্তাঘাট, স্বাভাবিক জীবন যখন ব্যাহত, তখন সেখানে অপেক্ষা করে কয়েক লাখ মানুষ। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় তিনি গণসংবর্ধনা মঞ্চে উপস্থিত হন।

লাখ লাখ জনতার সংবর্ধনার জবাবে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’

শেখ হাসিনা আরো বলেছিলেন, ‘আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেলসহ সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি, আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই। আপনাদের নিয়েই আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তা বাস্তবায়ন করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। বাঙালি জাতির আর্থ-সামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনতে চাই।’

মূলত স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নিরবচ্ছিন্ন দীর্ঘ সংগ্রাম শুরু হয়। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে সামরিক জান্তা ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে চলে তার সংগ্রাম। জেল-জুলম, অত্যাচার কোনো কিছুই তাকে তার পথ থেকে টলাতে পারেনি। বাংলার মানুষের হারিয়ে যাওয়া অধিকার পুনরুদ্ধার করতে জীবনের ঝুঁঁকি নিয়ে তিনি বারবার স্বৈরাচারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেছেন। আবির্ভূত হয়েছেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা রূপে।

আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর ৪৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বৈরশাসনের অবসান, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বাঙালির ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে। খাদ্যে স্বয়ংস্পূর্ণতা অর্জন করেছে দেশ। বঙ্গবন্ধুর খুনি ও একাত্তরের নরঘাতক মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করে রায় কার্যকর করা হয়েছে। তার সুযোগ্য নেতৃত্ব, যোগ্যতা, নিষ্ঠা, মেধা-মনন, দক্ষতা, সৃজনশীলতা, উদার গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে একসময় দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষে জর্জরিত বাংলাদেশ আজ বিশ্বজয়ের নবতর অভিযাত্রায় এগিয়ে চলছে। তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ ঘুচিয়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। জনগণের ভালোবাসায় অভিষিক্ত হয়ে টানা চতুর্থবারসহ পঞ্চমবার রাষ্ট্রপরিচালনার সুযোগ পেয়ে তিনি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং সব শ্রেণিপেশার মানুষের কল্যাণে যুগান্তকারী অবদান রেখে চলেছেন।

শেখ হাসিনা যখনই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তখন এ দেশের মাটি ও মানুষের কল্যাণে বাস্তবায়ন করেছেন বহুমাত্রিক উদ্যোগ। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি অগাধ প্রেম এবং অক্ষয় ভালোবাসাই হলো তার রাজনৈতিক শক্তি।

উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত গণতন্ত্র, আবার উন্নয়ন গণতন্ত্রেরও অন্যতম প্রভাবক। এ নিয়ে জ্ঞানবিশ্বে বিতর্ক শুরু হয় ১৭ শতকের দিকে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অল্প সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটায়। শুধু উন্নয়নের মাধ্যমে গণতন্ত্র অর্জন করা যায় না অথবা শুধু গণতন্ত্র উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট নয়। গণতন্ত্র ও উন্নয়ন আন্তসম্পর্কিত বিষয়টি বেশির ভাগ গবেষণায় প্রমাণিত। শেখ হাসিনা স্বদেশে ফিরে গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম ও গণতান্ত্রিক শাসন পরিচালনা করে উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

কর্মসূচি : শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগ। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে : ১৭ মে সকাল ৯টায় গণভবনে আওয়ামী লীগের নেতাদের শুভেচ্ছা বিনিময়। বিকেল সাড়ে ৩টায় তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ ভবনে আলোচনা সভা। দোয়া মাহফিল ও বিশেষ প্রার্থনা সভা : মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, গির্জাসহ সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দেশব্যাপী বিশেষ প্রার্থনা কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাদ জুমা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদসহ দেশের সব মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল। সকাল ৯টায় মিরপুর ব্যাপ্টিস্ট চার্চে (৩/৭-এ সেনপাড়া, পর্বতা, মিরপুর-১০) খ্রিস্টান সম্প্রদায়, সকাল ১০টায় রাজধানীর মেরুল বাড্ডার আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারে বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং সকাল সাড়ে ১১টায় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায় প্রার্থনা সভার আয়োজন করেছে।

"