বদরুল আলম মজুমদার

  ১৪ মে, ২০২৪

রাজপথে থাকার পরিকল্পনা বিএনপির

জাতীয় নির্বাচনের চার মাসের মাথায় সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে থাকার পরিকল্পনা নিয়েছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে ২৮ অক্টোবরের প্রায় ৭ মাস পর নয়াপল্টনে দুটি বড় সমাবেশ করেছে দলটি। সহযোগী সংগঠনের ব্যানারে আরো কয়েকটি সমাবেশের আয়োজন করবে বিএনপি। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মিত্র দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনাও শুরু করেছে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি। গত রবিবার চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এলডিপি ও ১২ দলীয় জোটের সঙ্গে লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক হয়েছে। আগামী কয়েক দিনে বাকি দলগুলোর সঙ্গেও মতবিনিময় করার কথা রয়েছে।

এদিকে ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে রাজপথে নামার পুরো পরিকল্পনা সমন্বয় করছেন দলের হাই কমান্ড। লন্ডন থেকে ইসলামি দলগুলোর নেতাদের সঙ্গেও সিরিজ যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে বলে দলগুলোর সূত্রে জানা গেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নামতে হবে এমন প্রস্তুতি বিএনপিতে ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছু পরিবর্তনের ইঙ্গিত পেয়েছে বিএনপি। সে সঙ্গে দেশের অর্থনীতির ভঙ্গুর দশায় টাকার অবমূল্যায়নে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, যার ধারাবাহিক প্রভাব জনজীবনে পড়তে শুরু করেছে। এর বাইরে রাজপথে নামার জন্য সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর চাপও বাড়ছে বিএনপিকে ঘিরে। এমন প্রেক্ষাপটে তড়িঘড়ি করে মাঠে নামতে বাধ্য হয়েছে বিএনপি। যা আগামী দিনগুলোয় আরো জোরদার হবে বলে জানা গেছে।

অপর দিকে রাষ্ট্রীয় এস্টাবলিসমেন্টের কট্টর সমর্থক একটি রাষ্ট্রের কূটনৈতিকদের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের সিরিজ বৈঠক হয়। সেই বৈঠকের পরই পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকেও বিএনপিকে রাজপথে থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

সূত্রগুলো এসব তথ্য নিশ্চিত করে আরো জানায়, সামনে কী ধরনের কর্মসূচি নেওয়া যায়, তা ঠিক করতে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি হাইকমান্ড থেকে সভা অব্যাহত আছে। দলটির ভ্যানগার্ড খ্যাত সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলও সারা দেশে জেলায় জেলায় কর্মিসভা শুরু করেছে। একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে কৃষক দলও। সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব কমানোর পাশাপাশি তাদের মাঠের আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকায় দেখতে চায় বিএনপি।

এদিকে সরকারবিরোধী একদফার আন্দোলনে লক্ষ্য অর্জন না হওয়ায় ক্রমেই বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব চলছিল সমমনা দলগুলোর। এমন পরিস্থিতিতে গত বুধবার গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সমমনা দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে স্কাইপে কথা বলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এরপরই দ্রুত পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে ধারাবাহিক বৈঠকের সিদ্ধান্ত হয়। এসব বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান অংশ নেন। সমমনা ছাড়াও সরকারবিরোধী আন্দোলনে মাঠে থাকা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও ধারাবাহিকভাবে বিএনপির বৈঠক করার কথা রয়েছে।

আন্দোলনে মাঠে নামার বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও ইঙ্গিত দিয়েছেন। গত শনিবার তিনি নয়াপল্টনের এক সভায় বলেন, বিএনপি আন্দোলন থেকে সরে যায়নি। পরিবর্তিত পরিবেশে আন্দোলনের মাঠে থাকার প্রয়োজনীতা আছে। দেশের মানুষ ভালো নেই। দেশের অর্থনীতি ভালো নেই। টাকা পাচার করে সরকার দেশকে ফুকলা বানিয়ে ফেলেছে, তাই জনগণের দল হিসেবে বিএনপিকে রাজপথে থেকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

হঠাৎ ফের মাঠের আন্দোলনে নামার পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির নীতিনির্ধারণী একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাদের কাছে মনে হচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এখন ক্ষমতাসীন দল অর্থনৈতিক সংকটসহ নানা কারণে বেকায়দায় পড়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে ভূ-রাজনীতি। ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুতে স্বার্থের দ্বন্দ্বে হঠাৎ ভূ-রাজনীতির পাশা এখন উলটে যাচ্ছে। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো এ অঞ্চলে যার যার জাতীয় স্বার্থকে বড় করে দেখছে। ফলে অনেক ফোরকাস্ট নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকদেরও ঘুম হারাম।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভূ-রাজনীতি আর মাঠের রাজনীতির দূরত্ব বেশি নয়। সংগত কারণে বিএনপিকেও এখন জাতীয় স্বার্থ ও জনস্বার্থের অনেক বিষয় সামনে নিয়ে মাঠে নামতে হচ্ছে। তিনি আরো জানান, জাতীয় নির্বাচনের পর অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। নির্বাচনের আগে এশিয়ার দুই শক্তিধর দেশের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের যে সম্পর্ক ছিল, নির্বাচনের পর এখন বিনিয়োগকেন্দ্রিক জাতীয় স্বার্থের দ্বন্দ্ব নতুন মেরুতে অবস্থান নিয়েছে। ফলে এ ইস্যুতে বাংলাদেশের সামনেও কঠিন পরীক্ষা। কে কার পক্ষ নেবে, কে কার প্রকৃত বন্ধু। সব হিসাবনিকাশ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে খুব দ্রুত। এ অবস্থায় বিএনপির মতো বৃহৎ দল বসে থাকতে পারে না। তাছাড়া সৃষ্ট জটিল সমীকরণ বিএনপি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

এদিকে বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে অনেকে এখন বিএনপির সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী বলে কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতা জানিয়েছেন। তারা আরো জানান, ক্ষমতাধর একটি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কয়েকবার বৈঠকও হয়েছে বিএনপি নেতাদের। বিষয়টি দলের হাইকমান্ড অবহিত আছেন।

মানুষের অধিকার বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত বিএনপির আন্দোলন অব্যাহত থাকবে জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, জনগণের কাছে সরকারের কোনো জবাবদিহিতা নেই, কোনো ম্যান্ডেট নেই, সরকারের মধ্যে দাম্ভিকতা তৈরি হয়েছে, সে জন্য জনগণের সমস্যা গুরুত্ব পাচ্ছে না, ক্ষমতায় টিকে থাকলেই হলো। একটা গোত্র তৈরি করেছে সরকার, যারা তাদের ক্ষমতায় রাখবে।

তাছাড়া উপজেলা পরিষদের প্রথম ধাপের ভোটও জনগণ বর্জন করেছে, যা বিদেশিরাও পর্যবেক্ষণ করেছে। উপজেলার ভোট বর্জনের মধ্য দিয়ে জনগণ আবারও পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, বর্তমান সরকারকে তারা সমর্থন করছে না। যে কারণে বিএনপি আবারও মাঠের আন্দোলনে নামতে চায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বগতি, তেল-গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিসহ জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে সামনে আরো কর্মসূচি আসবে।

তবে কী ধরনের কর্মসূচি হবে, তা দলের সিনিয়র নেতা ও মিত্রদের সঙ্গে পরামর্শ করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। নেতারা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু চলতি সপ্তাহে দুদিনের সফরে ঢাকায় আসছেন। তার সঙ্গেও বৈঠক হতে পারে বিএনপির। এমনকি ওই সময়ে রাজধানী ঢাকায় কোনো সমাবেশের কর্মসূচিও দেওয়া হতে পারে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close