মিজান রহমান

  ১৪ মে, ২০২৪

দেশে ডলার সংকটে অস্থির অর্থনীতি

ডলারের বিপরীতে টাকার মুদ্রামান আরো কমেছে। হঠাৎ করে ডলারের দাম বাড়ার কারণে অস্থির হচ্ছে অর্থনীতির সব খাত। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ। ডলারের দর বৃদ্ধিতে প্রভাব পড়বে বিদেশি ঋণ পরিশোধ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পণ্যের দামের ওপর। বাড়বে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা। এলসি সমন্বয় ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে আমদানি করা সব পণ্যের দাম বাড়বে। মূল্যস্ফীতি আরেক দফা বেড়ে যেতে পারে। এদিকে বাজারভিত্তিক ডলারের দর নির্ধারণের পর অবৈধ বাজারেও ডলারের খরা চলছে। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতির এখন হাঁসফাঁস ও দম বন্ধ অবস্থা। এ কথা বলেছেন ব্যবসায়ী এবং অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা।

তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এলসি খুলতে ব্যবসায়ীদের গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। খোলাবাজারে কোথাও কোথাও ডলারপ্রতি ১২৮ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে তাদের। আমদানিকারকরা এলসি খুলতে ব্যাংকে গিয়ে ডলার পাচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে ১১৭ টাকার বেশিতে ডলার কিনতে হচ্ছে রপ্তানিকারকদের। গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যাংকের অর্থায়নে হাসপাতাল নির্মাণ-সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যাংকের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ব্যাংক চেয়ারম্যানরা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিগত সিদ্ধান্তের পরিবর্তন আনছে, সেটি ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে আর্থিক খাতে।

দীর্ঘদিন ডলারের দর নিয়ন্ত্রণ করা হলেও শেষ পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ বাজার সমন্বয় ও আন্তর্জাতিক চাপে বাজারভিত্তিক ডলার মূল্য নির্ধারণের সিদ্ধান্তে যায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে পুরোপুরি বাজারে ছাড়ার আগে ক্রলিং পেগ নীতিতে মধ্যবর্তী দর নির্ধারণ করে ১১৭ টাকা করা হয়। যার থেকে ১ টাকা কম বেশিতে ডলার বেচাকেনা করতে পারবে ব্যাংকগুলো। পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনজুরুর রহমান বলেন, ১১৭ টাকায়ও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। রপ্তানিকারকদের কিনতে হচ্ছে আরো বেশি দরে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে একীভূত দুই ব্যাংক ছাড়া অন্য ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা উপস্থিত হন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তারা জানান, বাজারভিত্তিক বিনিময়মূল্যে যাওয়া সময়ের দাবি। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক এ মুহূর্তে বিভিন্ন স্তরে যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তা ইতিবাচক।

বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৮ মে ডলারের দাম ও ঋণের সুদের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পালনের অংশ হিসেবে ডলারের দাম ১১০ টাকা থেকে এক লাফে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা করা হয়। এতে সরাসরি প্রভাব পড়েছে ব্যাংক ও খোলাবাজারে। ফলে এলসি খোলার ক্ষেত্রে ১২০ এবং খোলাবাজারে প্রতি ডলারের দাম ১২৫ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এদিকে ডলারের দাম এক লাফে ৬.৩৬ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানি আমদানির খরচ বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, আমদানিতে সরাসরি ডলারের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে। এত কিছুর পরও বিলাসবহুল পণ্য আমদানি বন্ধ করা যাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো ডলার সংকটের অজুহাতে নিত্যপণ্যের এলসি খুলছে না। এমনকি রপ্তানিমুখী পণ্যের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রেও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে আমরা খোলাবাজার থেকে ডলার কিনছি। এক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম পড়ছে ১২৪ টাকা পর্যন্ত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান বলেন, ব্যাংকগুলো এলসি খোলার গতি কমিয়ে দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে বৈদেশিক মুদ্রা ডলারের আগমন কমে যাওয়ায় ডলার সমস্যার প্রধান কারণ। যত দিন ডলার আয় না বাড়ছে, তত দিন সংকট কাটবে না। ডলারের বহির্গমন কমাতে আমদানিতে কড়াকড়ি চলছে। কিন্তু এভাবে কত দিন চলবে? দেশের প্রয়োজনেই একটা সময় এ সীমা তুলে দিতে হবে। কারণ বিদেশ থেকে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি না করলে দেশের উৎপাদন ব্যাহত হবে। কমে যাবে কর্মসংস্থান। তার সঙ্গে কমে যাবে জাতীয় প্রবৃদ্ধি। সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সমস্যা সমাধান করতে হলে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধির বিকল্প নেই।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি টাকা ডলার ঋণের প্রাপ্তির শর্ত মেনে অনেকটা তড়িঘড়ি করে গত বুধবার ডলারের নতুন দর নির্ধারণ করা হয়। এরপর ডলারের দর এক লাফে ৭ টাকায় বৃদ্ধিতে বিদেশি ঋণ পরিশোধে বাড়তি খরচ বহন করতে হবে সরকারকে। এতে সরকারের বাজেটে ব্যয় বাড়বে। ডলারের দর বৃৃদ্ধিতে পূর্বে খোলা এলসি নিষ্পত্তিতেও প্রভাব পড়বে। কারণ এখন ৭-৮ টাকা বাড়তি দরে এলসি নিষ্পত্তি করতে হবে। এতে বিপাকে পড়বেন আমদানিকারকরা। কারণ আমদানি প্রক্রিয়াধীন পণ্যের জন্য তাদের ব্যয় এক লাফে ৬ শতাংশের বেশি বেড়ে যাবে। পাশাপাশি নতুন এলসি খোলার দরও এরই মধ্যে বেড়ে গেছে। গত বুধবার ১১৫ টাকায় এলসি করছিল এ রকম ব্যাংক। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার ডলার প্রতি ১১৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১১৮ টাকা দর নিচ্ছে এলসি খুলতে।

ডলারের দাম বাড়ার কারণে ডিজেলের দাম বাড়বে। সার আমদানির ব্যয় বাড়বে। কারণ আমদানিকারকরা বাড়তি টাকা দিয়ে ডলার কিনে যে পণ্যগুলো আমদানি করবে তা তাদের লাভসহ চড়া দামে বাজারে ছাড়বে। দেখা দিবে মূল্যস্ফীতি।

বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, জ্বালানি ও সার আমদানির জন্য ১১০ টাকা দামে ডলার বিক্রি করে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের দাম বাড়ানোর কারণে এসব পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যাবে। এখন সরকারের এসব সামাল দিতে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আমদানিকৃত জ্বালানি তেল ও কয়লার দামও সরাসরি ডলারে পরিশোধ করা হয়। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) গত বছর এক হিসাবে দেখায়, ডলারের বিনিময় হার এক টাকা বৃদ্ধিতে বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় বাড়ে ৪৭৪ কোটি টাকা। ফলে ডলার প্রতি ৭ টাকা দর বাড়াতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বেড়ে গেছে ৩ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলারের দর বাড়ানোর কারণে বিদেশি ঋণ পরিশোধ এবং জ্বালানি তেল ও সার আমদানির খরচ বেড়ে যাবে। তবে ডলারের দর অনেক বেশি আটকানো ছিল। তাই এটাকে স্থিতিশীল করতে হবে। এজন্য সুদহার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। সুদের হার উন্মুক্ত করায় যদি সফলতা আসে এবং ডলার যদি ১১৭ টাকায় থাকে তাহলে তা দেশের জন্য ভালো হবে।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ডলারের দাম বাড়ায় পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যাবে অনেক; এতে পণ্যের দামও বাড়াতে বাধ্য হবেন আমদানিকারকরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এখন আমাদের উচিত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের দিকে বেশি নজর দেওয়া। তাহলে দেশের উপকার হবে। ডলারের সংকট হ্রাস পাবে। কারণ এ ধরনের ব্যবসায়ীরা সর্বাংশে আমদানি-রপ্তানিনির্ভর নয়। ’

বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘আমাদের বেশির ভাগ ভোগ্যপণ্য আমদানিনির্ভর। নিঃসন্দেহে আমদানি পণ্যের দাম বাড়বে, যার প্রভাব পড়বে ভোক্তার ওপর। আমদানিকারকরা বেশি দরে পণ্য কিনলে বেশি দামেই বিক্রি করবে, তারা তো আর লোকসানে ব্যবসা করবেন না।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রলিং পেগ পদ্ধতি ঘোষণা সঠিক হয়েছে। তবে হঠাৎ করে এই পদ্ধতির জন্য বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close