কাইয়ুম আহমেদ

  ২০ এপ্রিল, ২০২৪

দখল দূষণ অবহেলায় রং হারিয়েছে বুড়িগঙ্গা

পানির রং কালচে, নেই অক্সিজেন। দূষণের মাত্রাও খুব বেশি। নদীটির পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেই দুর্গন্ধ এসে নাকে ঠেকে। আবার ভরাট আর দখলেও প্রায় প্রবাহশূন্য। ফলে শুধু বর্ষা ও শরৎ ছাড়া বাকি চার ঋতুতেই বেড়ে যায় তাপমাত্রা- এ অবস্থা ঢাকার প্রাণখ্যাত বুড়িগঙ্গা নদীটির; যে নদী ঘিরেই প্রায় ৪০০ বছর আগে গোড়াপত্তন হয়েছিল রাজধানী ঢাকার। কিন্তু সময়ের স্রোতে বুড়িগঙ্গা হারিয়েছে গতিপথ, প্রবাহ। দখল-দূষণে তিলে তিলে মেরে ফেলা হচ্ছে এই নদীকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বুড়িগঙ্গা নদীর বর্তমান অবস্থার জন্য বর্জ্য নিষ্কাশনের অপারগতা ও অবহেলাই মূলত দায়ী।

তথ্য বলছে, ধলেশ্বরীর কেরানীগঞ্জে হযরতপুর থেকে উৎপত্তি হয়ে কোন্ডা ইউনিয়নের জাজিরায় মিশেছে ৪১ কিলোমিটারের বুড়িগঙ্গা। অথচ গত ৩০ বছরে এই উৎস মুখ থেকে ১৬ কিলোমিটারই দখল হয়। এখানে গড়ে উঠেছে শতাধিক শিল্প-কারখানা ও ১৭টি ইটভাটা। বাকি ২৫ কিলোমিটার প্রবাহমান রয়েছে। এ নদীতে শুধু বর্ষা ও শরতে দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকে ছয় মাত্রায়। বাকি চার ঋতুতে নদীর তাপমাত্রা থাকে ২০ ডিগ্রির ওপর। পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ এক মাত্রায় নেমে আসে। অন্তত ১০০টি ড্রেন দিয়ে শিল্প ও নাগরিক বর্জ্য পড়ে নদীতে।

সম্প্রতি দোলেশ্বর ঘাট এলাকা থেকে শ্যামপুরের ফায়ার সার্ভিস ঘাট পর্যন্ত নদীর একটি অংশ ঘুরে দেখা গেছে দোলেশ্বর ঘাটের সিঁড়ির নিচ দিয়ে কারখানার বর্জ্য নদীতে পড়ছে।

পুরো এলাকায় খুব বাজে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল, যেটি যেকোনো মানুষের দম বন্ধ করে দিতে পারে। লক্ষ করা যায়, কিছু কিছু অংশে নদীর পানির রং গোলাপি হয়ে গেছে।

অন্যবারের মতো এবারও ঈদের দিন বিকেলে বুড়িগঙ্গার তীরে সপরিবারে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন বাংলাবাজার এলাকার বাসিন্দা আবু হানিফ। তিনি জানান, কালো ময়লা পানি আর বিকট দুর্গন্ধে বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি নদীর পাড়ে। তিনি বলেন, ‘যখন বুড়িগঙ্গার পানি ভালো ছিল, তখন ঈদের দিন ও আগে-পরে কয়েকদিন এখানেই ঘুরতে আসতাম। বিনোদনের কেন্দ্র ছিল নদীর পাড়। শত শত মানুষ এখানে এসে সময় কাটাত। নদী নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর এখন এখানে মানুষ এসে বেশিক্ষণ বসতে পারে না।

স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘এটা আসলে পানি না। এটা হলো বিষ। এখানে জলজ কোনো প্রাণী বাঁচতে পারে না। এখানে যদি কেউ কখনো পড়েও যায় তার আর বাঁচা সম্ভব না। মুহূর্তেই মরে যাবে।’

কেরানীগঞ্জ থেকে নিয়মিত নদী পার হয়ে আসতে হয় যাদের, তারাও ভালো নেই। ভুগছেন নানা শারীরিক সমস্যায়। এমনই একজন চুনকুটিয়ার রনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিদিনই এপার আসতে হয়। দুর্গন্ধে শ্বাসকষ্টের সমস্যা হয়ে গেছে।’

বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে নানা সময় নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও আলোর মুখ দেখেনি সে উদ্যোগ। আদালতের নির্দেশ অমান্য করেই কারখানা আর পয়োবর্জ্যে ডুবছে বুড়িগঙ্গা। ২০১৫ সালে প্রকাশিত ডিওইর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় ৮০ থেকে ১০০টি কারখানা প্রতি সেকেন্ডে আনুমানিক ৬০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য নদীতে ছেড়ে দেয়। এর পেছনে বর্জ্য নিষ্কাশনের অপারগতা ও অবহেলাই মূলত দায়ী।

সম্প্রতি ‘বুড়িগঙ্গা : নিরুদ্ধ নদী পুনরুদ্ধার’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিকভাবে বুড়িগঙ্গার সম্পূর্ণ অংশ শনাক্ত ও চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। নদীটির প্রকৃত উৎসমুখ ও দৈর্ঘ্য নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল। যেমন- পানি উন্নয়ন বোর্ড ২৯ কিলোমিটার, বিআইডব্লিউটিএ ৪৫ কিলোমিটার, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ২৯ কিলোমিটার এবং পর্যটন করপোরেশন ২৭ কিলোমিটার হিসেবে বুড়িগঙ্গার দৈর্ঘ্য উল্লেখ করেছে।

এ বিষয়ে নদীরক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন বলেন, বুড়িগঙ্গার ১৬ কিলোমিটার সরকারি নথি থেকে মুছে দেওয়ার মধ্য দিয়ে দখলকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এই শুকনো অংশে সীমান্ত পিলার দেওয়া হয়নি। পিলার দেওয়া হয়েছে কেবল বুড়িগঙ্গার প্রবাহমান অংশে। প্রবাহমান অংশে এক হাজারের মতো পিলার পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ৭০০ পিলার অক্ষত অবস্থায় নেই।

এক প্রশ্নের জবাবে শেখ রোকন বলেন, বুড়িগঙ্গায় ভরাট-দখলের ১৬ কিলোমিটার অংশ এখন তিন রকম অবস্থায় আছে। প্রথমত, সেখানে অনেক আবাসন প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা তৈরিসহ নানা ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আরেকটি অংশ ভরাট হয়ে ফসলি জমি হয়েছে। তৃতীয়ত, একটি অংশকে মানুষ খাল হিসেবে চেনে। সেখানে বর্ষায় পানি থাকে, কখনো শুকনো থাকে।

শেখ রোকন বলেন, ১৬ কিলোমিটার অংশ সরকারি দলিলপত্র থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। এই অংশকে বাদ দেওয়ার জন্য বুড়িগঙ্গার উৎপত্তি ধলেশ্বরী হলেও বলা হচ্ছে তুরাগ নদী। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি দলিলের ২০০৫ সালের সংস্করণে এই নদীর দৈর্ঘ্য দেখানো হয় ৪৫ কিলোমিটার। একই দলিলের ২০১১ সালের সংস্করণে বলা হচ্ছে, তা ২৯ কিলোমিটার। এই ১৬ কিলোমিটার বাদ দিয়ে দিচ্ছে।

‘বুড়িগঙ্গায় প্রাণ ফিরলে তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে’ : গবেষণায় বুড়িগঙ্গাসম্পর্কিত সরকারের আটটি প্রকল্প পর্যালোচনা করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, সরাসরি বা আংশিকভাবে বুড়িগঙ্গাবিষয়ক আটটি প্রকল্পে গত দুই দশকে অন্তত তিন হাজার ২৯৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু নদীটি পুনরুদ্ধারে এর প্রভাব দৃশ্যমান নয়।

দখলমুক্ত করে বুড়িগঙ্গায় প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারলে তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে মনে করেন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এই আয়োজনে আগে ধারণ করা ভিডিও বক্তব্যে তিনি বলেন, এত খরচের পরও বুড়িগঙ্গাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারল না সরকার। সরকার যে প্রক্রিয়ায় বুড়িগঙ্গাকে উদ্ধার করতে চায়, সেটি অনেক বেশি ব্যয়বহুল। সেই প্রক্রিয়ায় বুড়িগঙ্গাকে উদ্ধার করা যাবে না; বরং যে প্রক্রিয়াগুলো নদীকে ধ্বংস করছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। বৈষম্যহীনভাবে দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে।

গবেষণার সুপারিশে বলা হয়েছে, বুড়িগঙ্গার প্রবাহমান অংশের তীরবর্তী দখল উচ্ছেদের পর তা স্থায়ী করতে নজরদারি ও তদারকি প্রয়োজন। নাগরিক ও শিল্পবর্জ্যরে উৎসগুলো চিহ্নিত করে বন্ধ করতে হবে, না হয় তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন করতে হবে।

পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) বলছে, রাজনৈতিকভাবে হত্যা করা হচ্ছে বুড়িগঙ্গাকে। রাজধানীর শ্বাসনালী পুনরুদ্ধারে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘যদি নদীটাকে আমরা ভূমিদস্যু এবং কিছু দূষণকারীর হাতে তুলে দিই, তাহলে আমাদের বলতে হবে রাষ্ট্রের উন্নয়ন দর্শনে আমাদের পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা নদী মেরে দিয়ে উন্নয়ন চাই না।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close