দিলরুবা খাতুন, মেহেরপুর

  ১৭ এপ্রিল, ২০২৪

বৈদ্যনাথতলায় মাহেন্দ্রক্ষণ

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ বুধবার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় একটি দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণ করে। কুষ্টিয়া জেলার তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে এই অনুষ্ঠান হয়। সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা ও পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্দেশিত পথে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। ইতিহাসের মহাযজ্ঞের ভেতর দিয়ে বৈদ্যনাথতলা স্থানটি মুজিবনগর রূপান্তরিত হয়েছে।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল দিনটি ছিল শনিবার। ১৩৭৮ বঙ্গাব্দের ৩ বৈশাখ। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রথম অস্থায়ী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা শপথগ্রহণ করেন তৎকালীন বৈদ্যনাথতলা আমবাগানে। শপথ নিয়ে স্থানটিকে পূণ্যভূমিতে পরিণত করেন।

মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম প্রধান সংগঠক তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে ভারত যাওয়ার সময় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রণাঙ্গনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে মেহেরপুরের তৎকালীন বৈদ্যনাথতলার আমবাগান এলাকার নিরাপত্তা ও ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হন। পরে ১৭ এপ্রিল সেখানে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণ করেন তিনি। পরদিন (৩১ মার্চ) ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গোলক মজুমদার ও ৭৬ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমান মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ) জায়গা দেখিয়ে মঞ্চ তৈরি করতে বলেন। জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ১৬ এপ্রিল সকাল থেকে সারা রাত বাঁশের বাতা দিয়ে বেষ্টনী নির্মাণ এবং স্থানীয়ভাবে ভাঙা চেয়ার-টেবিল দিয়েই মঞ্চ তৈরির আয়োজন সম্পন্ন হয়। আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম আসে ভারতের হৃদয়পুর বিএসএফ ক্যাম্প থেকে। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয় আয়োজন।

১৭ এপ্রিল মাহেন্দ্রক্ষণে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ অন্য নেতাদের সঙ্গে নিয়ে সকাল ৯টার দিকে বৈদ্যনাথতলায় পৌঁছান। দেশি-বিদেশি শতাধিক সাংবাদিক ও ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও আসেন। তাদের মধ্যে ব্রিটিশ সাংবাদিক মার্ক ট্যালি ও পিটার হেস ছিলেন। বেলা ১১টায় শুরু হয় বহু প্রতীক্ষিত শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দীন আহমেদ স্থানীয় ১২ জন তৎকালীন ইপিআর-আনসারের একটি দল নিয়ে নেতাদের সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানান। অভিবাদন গ্রহণের পর স্থানীয় শিল্পীদের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। গৌরী নগরের বাকের আলীর কোরআন তেলাওয়াত ও ভবেরপাড়া গ্রামের পিন্টু বিশ্বাসের বাইবেল পাঠের মাধ্যমে শুরু হয় আনুষ্ঠনিক কার্যক্রম। পরে আওয়ামী লীগের চিফ হুইফ অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী স্বাধীনতাকামী কয়েক হাজার জনতা ও শতাধিক সাংবাদিকের সামনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।

রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্র প্রধান হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলামের নাম ঘোষণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে পরামর্শ করে আইন সংসদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে খন্দকার মোশতাক আহমদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এ এইচ কামারুজ্জামান ও অর্থমন্ত্রী হিসেবে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে পরিচয় করিয়ে দেন এবং শপথ পাঠ করেন। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানেই কর্নেল এম এ জি ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ কর্নেল আবদুর রবের নাম ঘোষণা করা হয়।

অনুষ্ঠানে ওই পর্যায়ে তাজউদ্দীন আহমদ ৩০ মিনিট ভাষণ দেন। বক্তব্যে তাজউদ্দীন আহমদ বিশ্ববাসীর কাছে নতুন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও সামরিক সাহায্যের আবেদন জানান। এ সময় তিনি বৈদ্যনাথতলাকে ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করেন। বক্তৃতা ও শপথগ্রহণ শেষে নেতারা মঞ্চ থেকে নেমে এলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার দেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। উপস্থিত জনতার মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে মুখরিত হয় আমবাগান। সব মিলিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে শেষ হয় অনুষ্ঠান। সেই দিন থেকেই বৈদ্যনাথতলা আনুষ্ঠানিকভঅবে মুজিবনগর নামে পরিচিত হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close