গাজী শাহনেওয়াজ

  ০৩ এপ্রিল, ২০২৪

এনআইডিতে ‘কমিশনার আউট, সচিব ইন’

জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) হারিয়ে গেলে কার্ডটি উত্তোলন, মৃত ভোটারের নাম কর্তন এবং কার্ডে থাকা ভুল সংশোধনে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের নামে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ক্ষমতা সংকুচিত করা হয়েছে। আগে এনআইডি-সংক্রান্ত কাজে ইসি সচিবের এখতিয়ার না থাকলেও নতুন করে তাকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত করা হয়েছে।

এনআইডি-সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে ডিজির নেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আপিল কর্তৃপক্ষ এখন আইন করে নির্বাচন কমিশন সচিবকে করা হয়েছে। আগে ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অপর চার নির্বাচন কমিশনার। এখন শুধু সচিবের সিদ্ধান্ত রিভিশন করতে পারবেন সাংবিধানিক পদধারীরা। বলা যায়, ক্ষমতাপ্রাপ্তের দিক থেকে আপিল কর্তৃপক্ষের ক্ষেত্রে ‘কমিশনার আউট, সচিব ইন’। নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমলাতন্ত্রের জাঁতাকলে পিষ্ট মানুষ। তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতেই নতুন নতুন এ কালাকানুন জারি করা হচ্ছে। এতে ন্যায্য এনআইডি সংশোধনের ক্ষেত্রে আবেদনকারীর ভোগান্ত্রিই বাড়বে বলে আশঙ্কা তাদের। কারণ এত ধাপ পেরিয়ে একটি ভুল আইডি সংশোধন করতেই জিন্দেগি পার হয়ে যেতে পারে একজন নাগরিকের।

আর কমিশনের সাবেকরা বলছেন, আপিল কর্তৃপক্ষ আইন দ্বারা সচিব ক্ষমতাপ্রাপ্ত হওয়ায় তাকে সফটলি ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে সুবিচার নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। এরপরও তার (সচিব) সিদ্ধান্ত রিভিশন করার ক্ষেত্রে কমিশন কতটুকু বাতিল আবেদনটি ঠেকাতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। এনআইডি একটি উইং আর সচিবালয়ের মুখপাত্র সচিব দুটির কাজের ধরন ভিন্ন। এতদিন সচিবকে এ কাজে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি সচিবালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমলারা সবকিছুতেই থাকতে চায়- এটাই সমস্যা। কথায় আছে, ‘বিচার মানি, তবে তালগাছ আমার’।

এছাড়া এনআইডি সংশোধনের ধরনে পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন উইং থেকে সারা দেশের বিভাগওয়ারি ক্যাটাগরি নির্ধারণ করার পর আবেদনের ঠিকানা অনুযায়ী সংশোধনের কাজ চলত। এমনকি ক্যাটাগরির ধরন আগে চারটি থাকলেও তা বাড়িয়ে ৭টি করা হয়েছে। আগে ক, খ, গ ও ঘ- এ চারটিতে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন ক ক্যাটাগরির সঙ্গে ক-১, খ ক্যাটাগরির সঙ্গে খণ্ড১ এবং গ ক্যাটাগরির সঙ্গে গ-১ এবং ঘ ক্যাটাগরি স্বতন্ত্র রাখা হয়েছে।

আগে ক্যাটাগরির কাজটি এনআইডিতে দায়িত্ব বণ্টনকারী কর্মকর্তারা করলেও নতুন এ সিদ্ধান্তের আলোকে সংশোধনের ধরন অনুযায়ী আবেদনগুলো শ্রেণি বিভাজন-সংক্রান্ত কার্যক্রম ইসির ১০টি অঞ্চলে কর্মরত ২০ অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা সম্পাদিত করবেন। অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার এ-সংক্রান্ত কার্যক্রম জেলাভিত্তিক বিভাজন অনুসারে পরিচালিত করবেন। এটা জেলা বিভাজন আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা দ্বারা নির্ধারণ হবে। তবে হেড অফিসে সীমিত পরিসরে ক্যাটাগরি নির্ধারণের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে প্রয়োজনীয়সংখ্যক সহকারী পরিচালক বা উপপরিচালককে (প্রতিকল্পসহ) দায়িত্ব প্রদান করা হবে। এক্ষেত্রে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের নামে ক্ষমতাহীন হলেন এনআইডি উইংয়ের কর্মকর্তারাও।

কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, আগে কোনো সচিব এনআইডি নিয়ে হস্তক্ষেপ করায় আগ্রহ দেখাতেন না। বর্তমান সচিব সবকিছুতেই নিজের কর্তৃত্ব জাহির করতে মরিয়া। তার একক সিদ্ধান্তে আরব আমিরাতে জাতীয় ভোটার পরিচয়পত্র করতে বাধ্য হয়; কারণ তার ভাই সেখানে রাষ্ট্রদূত। এবার এনআইডি সংশোধনে ডিজির বাতিল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল কর্তৃপক্ষ হচ্ছেন সচিব। আইনের ২৭ ধারায় বলা হয়, মহাপরিচালকের সিদ্ধান্তে কোনো ব্যক্তি সংক্ষুব্ধ হলে এ-সংক্রান্ত আদেশ অবহিত হওয়ার ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে আবেদনকারী বা ক্ষেত্রমতে তার আইনানুগ প্রতিনিধি নির্ধারিত পদ্ধতিতে ওই আদেশের বিরুদ্ধে সচিব, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় বরাবর আবেদন করতে পারবেন। এটি আপিল প্রাপ্তির ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। বলা আছে, আপিল আবেদন বাতিলের বিরুদ্ধে দাখিল হওয়া আবেদনের ক্ষেত্রে কমিশন আপিল সিদ্ধান্ত ‘রিভিউ’ করতে পারবেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় পরিচয়পত্র ও সংরক্ষিত তথ্য-উপাত্ত (সংশোধন, যাচাই এবং সরবরাহ) প্রবিধানমালা-২০১৪ এবং প্রবিধি ২(৫)-এ সংজ্ঞায়িত এবং ওই প্রবিধিমালার প্রবিধি ৩ ও ৪-এ আবেদন দাখিল এবং আবেদন নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ও তার দায়িত্ব নির্ধারণ করে গত ২১ নভেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে এতদিন আইনি কার্যকর করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন।

এ লক্ষ্যে সিস্টেম উন্নতকরণের ত্রুটি খতিয়ে দেখার জন্য বিভিআরএস এবং এবিআইএস সিস্টেম উইথ স্পেশাল অ্যামপেসিস অন অ্যানহেন্সমেন্ট অব ডাটা প্রটেকশন এবং সিকিউরিটি শীর্ষক দুদিনের (২৪ ও ২৫ মার্চ) কর্মশালার আয়োজন করা হয়। সেখানে বায়ো-এনরোল, আপলোডার, সিএমএস, সিটিজেন পোর্টাল ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে ওই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সেখানে বর্তমান সিস্টেমে কোনো সমস্যা আছে কি না, সমস্যা উত্তরণের উপায়, সিস্টেমকে আরো ইউজার ফ্রেন্ডলি করা, নতুন কোনো ফিচার যুক্ত করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখা এবং বর্তমান সিস্টেমের নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে কর্মকর্তাদের সমৃদ্ধ করা। চলতি মাস থেকে ক্যাটাগরিসহ এনআইডি সংশোধন-সংক্রান্ত কার্যক্রম ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের কাজ শুরু হবে। এনআইডি উইং থেকে এমনই তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।

এসব বিষয়ে মন্তব্য পেতে কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম এবং অতিরিক্ত সচিব ও এনআইডি ডিজির চলতি দায়িত্ব পালন করা অশোক কুমার দেবনাথকে ফোন করা হলেও রিসিভ না করায় তাদের বক্তব্য জানা যায়নি। তবে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আপিল কর্তৃপক্ষ কমিশনের কাছে থাকলে ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয় সংক্ষুব্ধ আবেদনকারীর। কারণ কমিশন সাংবিধানিক দায়িত্ব থেকে অনেক অনুকম্পা দেখানোর সুযোগ থাকে। আবার কমিশনের তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন হলে সচিবের মাধ্যমে এসে থাকে। তাই সচিবকে একটা স্টেজে রাখলে মন্দ হয় না। তবে এক্ষেত্রে সচিবকে সাধারণ মানুষের সমস্যা বিবেচনায় নিচের কর্মকর্তাদের চেয়ে সফটলি হ্যান্ডলিং করতে হবে। তা না হলে দায়িত্ব বণ্টন নিয়ে সচিবের সিদ্ধান্তের সমালোচনা ও প্রশ্ন উঠবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

তবে দ্বিমত পোষণ করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। প্রতিদিনের সংবাদকে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। আর সরকারের যারা আমলা, তাদের মধ্যে অনেক ধরনের অনিয়ম, অন্যায় ও অবিচার করার মানসিকতা তৈরি হয়ে গেছে। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সমস্যা। আপিল কর্তৃপক্ষ কমিশনের পরিবর্তে সচিবকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত করার কারণে সমস্যা হতে পারে কি না- জানতে চাইলে এ নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বলেন, হতেই পারে। কারণ রাজনৈতিক বিবেচনায় হতে পারে।

আর নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবেদ আলী প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আমাদের একটি দাবি ছিল এনআইডি সংশোধন-সংক্রান্ত কাজটি একটি জায়গা থেকে করা হোক। এখানে সচিবালয়ের প্রধান হিসেবে সচিবকে সাচিবিক অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। সেখানে আমলা হিসেবে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে সাধারণ একজন নাগরিক ন্যায়বিচার পাবেন- এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় না। কারণ যারা সিদ্ধান্তটি বাতিল করছেন তারাও আমলা। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ যত বাড়বে, মানুষের হয়রানি তত বাড়বে। তিনি বলেন, অনেক সচেতন নাগরিকের এনআইডি সংশোধন করতে গিয়ে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এনআইডি সংশোধনের একক দায়িত্ব মহাপরিচালকের, তার কাছেই পৌঁছাতে একজন ভুক্তভোগীর কালঘাম ছুটে যায়; সেখানে সচিবের নাগাল পাওয়া কঠিন হবে। এনআইডির ওপরে সচিব তার কর্তৃত্ব খাটাতে- এ দায়িত্ব বণ্টন করে নিয়েছেন। এখানে কমিশনকে রিভিশনের জায়গায় রেখে সচিবকে আপিল কর্তৃপক্ষ করা হয়েছে, যা সাংবিধানিক পদের মর্যাদাহানি করা হয়েছে।

বলা যায়, এনআইডির সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে ‘কমিশন আউট, ইন সচিব’। বলেন, আমাদের ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের পক্ষ থেকে একটা প্রস্তাব ছিল, দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনাসহ সব ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজ হলেও এখানে কেন হচ্ছে না। এর কারণ দুর্নীতি। তা না হলে একটি এনআইডি সংশোধনে এত দীর্ঘসময় কেন লাগবে। আর এতগুলো জায়গায় কেন যেতে হবে। তারপর একটি এনআইডি সংশোধন করতে হয় এখন আপিল কর্তৃপক্ষ সচিব হওয়ায় আবেদন কর্তৃপক্ষের অপেক্ষা আরো বাড়বে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close