নিজস্ব প্রতিবেদক

  ৩১ মার্চ, ২০২৪

শিক্ষায় ব্যয় বেড়েছে

* বড় অংশ গেছে কোচিং-প্রাইভেট ও নোট-গাইডে * প্রাথমিকে ২৫ ও মাধ্যমিকে ৫১ শতাংশ

দেশের শিক্ষা খাতেও বেড়েছে ব্যয়। গত বছরের প্রথম ৬ মাসে আগের বছরের (২০২২) তুলনায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে যথাক্রমে ২৫ এবং ৫১ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে। এ ব্যয়ের বড় অংশ গেছে কোচিং-প্রাইভেট এবং নোট-গাইডের পেছনে। শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযানের উদ্যোগে করা ‘বাংলাদেশে বিদ্যালয় শিক্ষা : মহামারি-উত্তর টেকসই পুনরুত্থান’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

গতকাল শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সংবাদ ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে ‘এডুকেশন ওয়াচণ্ড২০২৩’ নামে এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। দেশের ৮ বিভাগের ১৬টি জেলার মধ্যে থেকে ২৬টি উপজেলা ও ৫টি সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে গবেষণাটি করা হয়েছে। গবেষণার জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষা কর্মকর্তা এবং জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা মিলিয়ে ৭ হাজার ২২৫ জনের কাছ থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণি এবং নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার খরচের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের ব্যয়ের চিত্রটি বের করা হয়েছে।

গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরেন গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক ও গবেষক দলের সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান। অনুষ্ঠানে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘গবেষণা প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে তুলে দেওয়া হবে।’ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘২০২২ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর জন্য বার্ষিক পারিবারিক গড় ব্যয় ছিল ১৩ হাজার ৮৮২ টাকা। তবে শহরাঞ্চলে এ খরচ বেশি। মফস্বল এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষার্থীপিছু বার্ষিক পারিবারিক ব্যয় ছিল ১০ হাজার ৬৩৭ টাকা; যা শহরাঞ্চলে ছিল ১৮ হাজার ১৩২ টাকা। কিন্তু পরের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের প্রথম ৬ মাসেই প্রাথমিকে এ খরচ ২৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৬৪৭ টাকা।’ ২০২২ সালে মাধ্যমিক স্তরের একজন শিক্ষার্থীর জন্য পরিবারের ব্যয় ছিল ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা। মফস্বল এলাকায় এ খরচ ২২ হাজার ৯০৯ এবং শহরাঞ্চলে ৩৫ হাজার ৬৬২ টাকা। কিন্তু গত বছরের প্রথম ৬ মাসে এ খরচ ৫১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৭১২ টাকা। এর বড় অংশই ব্যয় হয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় ক্ষেত্রেই প্রাইভেট টিউটরের বেতন ও নোট-গাইড বই বাবদ। গবেষণার তথ্য বলছে, প্রাথমিক পর্যায়ে ৫৬.৫ ও মাধ্যমিকে ৫২.৬ শতাংশ শিক্ষার্থী মহামারির পর তাদের নতুন শ্রেণির পাঠ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে। কিন্তু প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী পাঠ বোঝার ক্ষেত্রে অসুবিধায় ছিল। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে তিন-চতুর্থাংশের বেশি শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউটরের সহায়তা নিয়েছে বা কোচিং সেন্টারে গেছে।

শিক্ষার্থী ও অভিভাবক উভয়ের কাছ থেকে একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। শ্রেণিকক্ষে যথাযথ পাঠদান না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা গাইড বইয়ের ওপর অধিক নির্ভরশীল ছিল। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় এ নির্ভরতার হার ছিল যথাক্রমে ৯২ ও ৯৩ শতাংশ। প্রাথমিক পর্যায়ের ৪১ ও মাধ্যমিকের ৫৮ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী জানিয়েছে, তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। তবে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮ ও মাধ্যমিকের ১৭ শতাংশ স্কুলের কাজে বা লেখাপড়া-সংক্রান্ত কাজে ইন্টারনেটের ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছে।

এদিকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষকের ‘ব্লেন্ডেড লার্নিং (অনলাইন ও সশরীরে)’ পদ্ধতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার সংক্রমণজনিত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের একটি বিদ্যালয় ছাড়ার পর আর ফিরে আসেনি। ২০২০ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে লেখাপড়া করত এমন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২০২৩ সালে এসে দেখা গেছে তাদের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির ৪.৫ এবং ষষ্ঠ শ্রেণির ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ঝরেপড়া মহামারির জন্য প্রভাবিত। এজন্য যে কারণগুলো উঠে এসেছে, সেগুলো হলো- মহামারির কারণে নিম্নআয়ের পরিবারগুলোর আরো কমে যাওয়া, বিদ্যালয়ে পড়ালেখার জন্য অভিভাবকদের খরচ বৃদ্ধি, মহামারির কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয় বন্ধ থাকা এবং বিদ্যালয় থেকে যথাযথ নির্দেশনার অভাব। ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তারা বিদ্যালয়ে ফিরতে আগ্রহী কি না? জবাবে প্রাথমিক স্তরে ৫৭ এবং মাধ্যমিক স্তরে ৭৯ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছে, তারা আর বিদ্যালয়ে ফিরতে আগ্রহী নয়। ঝরেপড়া শিক্ষার্থীরা বর্তমানে কী করে, সেটিও জানার চেষ্টা করা হয়েছে এ গবেষণায়। তাতে প্রাথমিক স্কুল বয়সি শিশুদের ৪১ এবং মাধ্যমিক স্তরের ৪৯ শতাংশ বলেছে, তারা কাজ বা শিশুশ্রমে নিয়োজিত আছে।

সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ গবেষণা দলের প্রধান ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ বলেন, করোনার কারণে বড় অভিঘাত হয়েছে। কিন্তু সেটা যেন আমলে নেওয়া হচ্ছে না। এডুকেশন ওয়াচের চেয়ারপারসন ও জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন গবেষণার পর্যালোচক আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী, গবেষক দলের সদস্য সৈয়দ শাহাদাত হোসাইন, মো. আহসান হাবিব প্রমুখ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close