নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৪ মার্চ, ২০২৪

বেইলি রোড ট্র্যাজেডি

‘বেঁচে ফিরেছি, কিন্তু মন পুড়ে গেছে’

স্ত্রী-দুই সন্তানকে নিয়ে বেইলি রোডের সেই গ্রিন কোজি কটেজের পাঁচতলায় রেস্টুরেন্ট খেতে গিয়েছিলেন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান বিভাগের ডিন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান। যিনি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যায়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। ভাগ্যক্রমে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াল থাবা থেকে বেঁচে যান পরিবারের সবাই। সেই লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন প্রতিদিনের সংবাদের কাছে। মৃত্যুর দীর্ঘ সারি আর মানুষের আহাজারি দেখেছেন তিনি। কামরুজ্জামান জানান, রেস্তোরাঁয় ১ মার্চ বড় মেয়ে তার জন্মদিন পালনের আবদার করছিল। তার অনুরোধে পরিবার নিয়ে গ্রিন কোজির পাঁচতলার ‘জেস্টি’ নামে রেস্তোরাঁয় রাত পৌনে ১০টার দিকে যান।

অগ্নিকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘সবেমাত্র খাবার অর্ডার করেছি। এমন সময় পোড়া গন্ধ পেয়ে উঠে দেখি লোকজন চিৎকার করছে। হালকা ধোঁয়া আসতে লাগল। এরপর ক্রমেই চিৎকার বাড়তে থাকে।’ প্রথমে তারা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার চেষ্টা করেন। কিন্তু নিচ থেকে লোকজন ওপরে উঠতে ও ধোঁয়া বাড়তে থাকায় নিজেরাও ছাদে আশ্রয় নেন। কামরুজ্জামান বলেন, ছাদে গিয়ে দেখি সেখানেও একটি রেস্তোরাঁ। ধীরে ধীরে ওই রেস্তোরাঁ পর্যন্ত আগুনের ধোঁয়া আসে। ছাদে ১৫ ফুটের মতো ফাঁকা জায়গা ছিল। সেখানেই অন্তত ৫০ জন গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন মনে হয়েছে, এই বুঝি সবাই মারা যাব। অনেকেই তখন নামাজ পড়া শুরু করেন। প্রার্থনা ও বাঁচার আকুতি জানাতে থাকেন। এ সময় বড় মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, বাবা, আমার জন্মদিনে সবাই মিলে মারা যাব। একপর্যায়ে দরজা ও দেয়াল ভেঙে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন ঢুকে মই দিয়ে ছাদ থেকে প্রথমে শিশু ও নারীদের উদ্ধার করেন।’

ভবনে আটকা পড়ার পর কোন জিনিসটার অভাববোধ করছিলেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আটকা পড়ার পর অনেকে জানতেই পারেনি যে ভবনে আগুন লেগেছে। কেউ কেউ ১০ মিনিট পর জানতে পারে। তখন তারা ছোটাছুটি শুরু করে। আতঙ্কে কেউ নিচে নামে আবার কেউ ওপর দিকে ছুটে। চারিদিক যদি কাচ দিয়ে আবদ্ধ না থাকতো তাহলে হয়তো আরো আগেই জানতে পারতাম। আর এতগুলো মানুষ মারা যেত না। সিড়ি ছিল একটা আর সেটিতে চাপাচাপি করে মানুষ নড়তে পারছিল না। ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ার পর হয়তো পরে যারা আটকে পড়ে কেউ চোখে দেখতে পাইনি। আর ধোঁয়া বের হতেও পারেনি।’

বেঁচে ফেরার সেই দৃশ্য মনে করে তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের ভাইয়েরা আমাদের বাঁচিয়েছেন। প্রথমে নারী ও শিশুদের উদ্ধার করেন পরে আমরা নেমে আসি। সব ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট সেদিন যে কর্মযজ্ঞ করেছে সেটি তারা আজকে করছে না কেন? আজকে যদি তারা অভিযান পরিচালনা করেন তাহলে এই বেইলি রোডের সবগুলো বিল্ডিং নিরাপদ করা সম্ভব। সেদিন কাজ করতে জীবন বাজি রেখেছেন কিন্তু আজকে কাজ করতে গেলে তো আর জীবন বাজি রাখতে হবে না। আগুন লাগার পর সবাই আসেন তদন্ত করতে কিন্তু আগে থেকেই কেন পদক্ষেপ নেন না- এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি।

নিরাপদ ভবন নিয়ে এই অধ্যাপকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিটি ভবনে একটি বড় বোর্ডে লিখে দেওয়া হবে নিদর্শন মানার চিহ্ন। যদি রাজউকের শর্ত বিল্ডিংয়ে পূরণ থাকে তাহলে একটি টিকচিহ্ন থাকবে। ফায়ার সার্ভিসের একটি টিকচিহ্ন থাকবে। সিটি করপোরেশনের একটি টিকচিহ্ন থাকবে। যদি কোনোটির একটি না থাকে তাহলে সেটি লাল ক্রস দিয়ে দেবে। সেটি বন্ধ করে দেবে। থাকবে সবুজ টিকচিহ্ন থাকবে। আমরা ভবনে ঢোকার আগেই জানতে পারব সেই ভবনটি নিরাপদ কি না।

আবাসিক ভবনের রেস্তোরাঁর বিষয়ে তিনি বলেন, আমি আসলে সেদিন পরিবারসহ বেঁচে গেছি কিন্তু মন পুড়ে গেছে। আমার আত্মা পুড়ে গেছে। আবাসিক ভবনে রেস্তোরাঁ করার পক্ষে আমি নই। এই ধরনের রেস্তোরাঁ আসলে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবে। যদি নিরাপত্তা করতে না পারেন তাহলে ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ হবে। এটি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close