মেহেদী হাসান

  ০৪ মার্চ, ২০২৪

পুড়ে যাওয়া গ্রিন কোজি কটেজ

হতবিহ্বল চোখ থমকে যায়

গতকাল রবিবার দুপুর ১২টা। মাথার ওপর ঝলমলে রোদ ঠিকরে পড়ছে। কিন্তু এই রোদেলা দুপুরেও শত শত পথিকের চোখে-মুখে যেন নেমে এসেছে অন্ধকার। তারা দেখছে- বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামের আগুনে পুড়ে যাওয়া ভবনটি; যে ভবন কেড়ে নিয়েছে ৪৬ প্রাণ। ঘটনাটি বৃহস্পতিবার ঘটলেও এখনো অসংখ্য মানুষের ভিড় দেখা যায় ভবনটির সামনে। ভিড়ের মধ্যে দেখা মেলে ছোট্ট তাসনিমের। জানা গেল পুরো নাম তাসনিম জাহান। পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। মা জান্নাতুল ফেরদৌসের হাত ধরে পুড়ে যাওয়া ভবন দেখছিল সেও। মাকে বলছিল, ‘মা এই বিল্ডিংয়ে কি এখনো পুড়ে যাওয়া মানুষ আছে?’ মেয়ের এমন প্রশ্নে মায়ের উত্তর, ‘না, মা; ভেতরে কেউ নেই।’

শুধু তাসনিম জাহান নয়; সিদ্ধেশ্বরী গার্লস হাইস্কুলের অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক ভিড় করেন বেইলি রোডের সেই অগ্নিদগ্ধ ভবনের সামনে। আছে পুলিশ ভ্যান। জটলা পাকিয়ে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঘটনার সবশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। মতামত নিচ্ছেন সাধারণ মানুষের। নানা সময়ে পরিদর্শনে আসছেন বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। সবমিলিয়ে যেন সরগরম চারপাশ। সবার চোখে উৎসুক চাহনি, মুখে আফসোস-দীর্ঘশ্বাস।

এখানে আসা দর্শক তানিয়া রহমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আমরা আসলে কোথায় নিরাপদ আছি! রাস্তায় চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যেতে পারি। খাবার খেতে এসেও জীবন চলে যাবে- কেউ কোনো দিন ভাবতে পেরেছে। আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কি নিরাপদ বাসযোগ্য করে রেখে যেতে পারছি। স্বাভাবিক মৃত্যুর নিরাপত্তা চাই।’

বেইলি রোডের পুড়ে যাওয়া ভবনের ঠিক সাত বাড়ি পরেই রাকিবুল হাসান (ছদ্মনাম) ভাড়া থাকেন। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আপনি দেখেন, এই পুড়ে যাওয়া ভবনের পাশেই আরেকটা ভবন আছে। সেই ভবনের নিচের দিকে রেস্টুরেন্ট আর ওপরের দিকে আবাসিক। নিচে আগুন লাগলে ওপরের মানুষ কোন দিক দিয়ে বের হবে? সেদিন যদি আগুন পাশের ভবনের ছড়িয়ে পড়ত তাহলে তারা বাঁচতে পারত কি? এসব বললে এ দেশে হুমকি পেতে হবে। আমার নাম নিউজে ব্যবহার করবেন না দয়া করে।’

বেইলি রোডের শেষ প্রান্তে ভাড়া থাকেন জমুনা আক্তার জয়া। প্রথম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে স্কুল ছুটি শেষে এসেছেন পোড়া ভবন দেখতে। কথা হয় তার সঙ্গেও। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই আমাদের প্রিয় সন্তানদের জন্য নিরাপদ একটা শহর রেখে যেতে। আমরা চাইলেও তা পারব না। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও আমাদের সাধারণ জনগণকেও ভূমিকা পালন করতে হবে। কাচ দিয়ে ঘিরে ঘরকে বদ্ধ করে আমরা নিজেদের ক্ষতি করছি। বিল্ডিংগুলোর সিঁড়ি তৈরি করতে কার্পণ্য করি। সরকার তো আর সবকিছু দেখতে পারবে না। আমাদের দিকে আমাদেরই দেখতে হবে।’

সাইফুল ইসলাম পেশায় রিকশাচালক। জানতে চাইলে তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘ঘটনার দিন থেকে এখানে ভিড় লেগেই আছে। কোনো সময় মানুষ কমে না। পুড়ে যাওয়া বিল্ডিং দেখতে অনেকে শিশুসন্তান নিয়ে আসছেন। আমি রিকশা করে অনেককে নিয়ে এসেছি। এতগুলো মানুষ মারা গেছে, তাই আসছে। ঘটনার দিন গ্রিন কোজি কটেজের পঞ্চমতলায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে খেতে এসেছিলেন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান বিভাগের ডিন ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার।’

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আমি সেদিন আল্লাহর রহমতে বেঁচে গেছি। আগুন লাগার পর ১০ মিনিট পর্যন্ত অনেকে জানতেই পারেননি যে বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছে। তারপর ছাদে উঠে পড়ি। যদি সেটিও না থাকত! চারদিকে কাচ দিয়ে ঘিরে একটা অভেন বানানো হয়েছে। আগুন লেগে ধোঁয়া বের হতে পারেনি ফলে মানুষ মারা গেছে। যদি খোলামেলা হতো তাহলে অনেকেই হয়তো বেঁচে যেতেন মনে হয়। আমাদের ভবনগুলোর ডিজাইন নিয়ে ভাবতে হবে। এত বড় ভবনে বের হওয়ার কোনো এক্সিট নেই। সরকারি দপ্তরগুলোর কর্মতৎপরতা নিয়ে ভাবতে হবে। আর কত দিন এভাবে চলে বলতে পারেন। মানুষের আফসোস দিয়ে কাজ নেই, কাজে প্রমাণ করতে হবে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close