প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

টাটার সম্পদ পাকিস্তানের জিডিপির চেয়েও বেশি

টাটা গ্রুপ অব কোম্পানির সম্পদের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। এ তথ্য জানা গেছে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে। এ সম্পদ টাটা গোষ্ঠীকে ভারতের সবচেয়ে মজবুত সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। জানা গেছে, টাটা গোষ্ঠীর সম্পত্তি পাকিস্তানের ‘গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট’ বা জিডিপির চেয়েও বেশি। খবর বিবিসির।

রিলায়েন্স গ্রুপের প্রধান মুকেশ আম্বানি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হয়েছেন বা বিলিয়নেয়ার ব্যবসায়ী গৌতম আদানি তাকে (মুকেশ আম্বানি) পেছনে ফেলে দিয়েছেন। কিন্তু এদের মধ্যে টাটার কোনো উল্লেখ শুনতে পাবেন না। অথচ চা থেকে শুরু করে জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার গাড়ি এবং লবণ তৈরি থেকে বিমান পরিষেবা বা হোটেল গ্রুপ চালানো, জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে টাটা গোষ্ঠীর প্রভাব দৃশ্যমান। চলতি মাসে টাটা গ্রুপের মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন ছিল ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলার।

ইন্টারন্যাশানাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) সম্প্রতি জানিয়েছে, তাদের অনুমান অনুযায়ী পাকিস্তানের জিডিপি ৩৪ হাজার ১০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ পাকিস্তানের জিডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে টাটা গোষ্ঠীর সম্পদ। আমরা যদি শুধু টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসের কথাই বলি, তাহলে এ কোম্পানির সম্পদ হলো ১৭ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এর সম্পদ পাকিস্তানের অর্থনীতির প্রায় অর্ধেক। টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস হলো ভারতের দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় সংস্থা। ১৮৬৮ সালে জামশেদজি টাটা এ শিল্প সংস্থার প্রতিষ্ঠা করেন। ১৫০ বছর সময় লেগেছে এ সাফল্য ছুঁতে। ১৯১১ সালে টাটা গ্রুপের প্রধান স্যার দোরাবজি টাটা তার বাবা জামশেদজি টাটার চিন্তাভাবনার কথা বলেছিলেন। দোরাবজি টাটা ১৮৬৮ সালে এ কোম্পানির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। এ শিল্প গোষ্ঠীর অধীনে ১০টি ভিন্ন ভিন্ন খাতে ব্যবসা করে এরকম ৩০টি কোম্পানি রয়েছে।

দোরাবজি টাটা বলেছিলেন, ‘আমার বাবার জন্য, সম্পদ উপার্জন করা অনেক পরের বিষয় ছিল। তিনি এদেশের মানুষের শিল্প ও সামগ্রিক অবস্থার উন্নয়নকে সবসময় অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে টাটার প্রতিষ্ঠাতা জামসেটজি টাটাকে তার চেহারার কারণে বোম্বের একটি দামি হোটেলে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এ ঘটনা তার ওপর তীব্র প্রভাব ফেলেছিল। তিনি স্থির করেন, এর চেয়ে অনেক ভালো একটি হোটেল তৈরি করবেন তিনি, যেখানে প্রত্যেক ভারতীর আসা যাওয়ার অনুমতি থাকবে। এভাবে ১৯০৩ সালে মুম্বাইয়ে সমুদ্রের ধারে তাজ হোটেল তৈরি হয়। এ হোটেল মুম্বাই শহরের একমাত্র ইমারত ছিল, যেখানে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, আমেরিকান পাখা এবং জার্মান লিফটের ব্যবস্থা ছিল। ইংরেজ খানসামারা এ হোটেলের কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। এখন আমেরিকা এবং ব্রিটেনসহ ৯টি দেশে এর শাখা রয়েছে।

জামশেদজি টাটা ১৮৩৯ সালে একটি পারসি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পূর্বপুরুষদের অনেকে পারসি ধর্মগুরু ছিলেন। তিনি কাপাস (এক ধরনের তুলা), চা, তামা, পিতল এবং আফিমের (সেসময় বেআইনি ছিল না) ব্যবসায়ে প্রচুর অর্থ রোজগার করেন। পুরো বিশ্ব ঘুরে দেখেছিলেন এবং নতুন নতুন আবিষ্কার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন জামশেদজি টাটা। ব্রিটেন সফরের সময় ল্যাঙ্কাশায়ারে কটন মিল দেখার পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এক্ষেত্রে ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। সালটা ১৮৭৭। ‘মহারানি মিলস’ নামের দেশের প্রথম টেক্সটাইল মিল খোলেন জামশেদজি টাটা। কুইন ভিক্টোরিয়াকে যেদিন ভারতের সম্রাজ্ঞী হিসেবে মুকুট পুরোনো হয়েছিল সেদিন ‘মহারানি মিলস’র উদ্বোধন করা হয়।

জামশেদজি টাটার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল একটি ইস্পাত কারখানা তৈরি করা। কিন্তু এ স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়। ছেলে দোরাবজি টাটা তার বাবার মৃত্যুর পর সেই স্বপ্ন পূরণ করেন। টাটা স্টিল ১৯০৭ সালে উৎপাদন শুরু করে। জামশেদজি টাটা তার ছেলে দোরাবকে একটি শিল্প শহর প্রতিষ্ঠার জন্য চিঠি লিখেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘এ শহরের রাস্তা চওড়া হওয়া উচিত। গাছপালা, খেলার মাঠ, পার্ক এবং ধর্মীয় স্থানের জন্যও জায়গা থাকতে হবে।’

টাটা নিজেই তার কর্মচারীদের কল্যাণের জন্য ১৮৭৭ সালে পেনশন, ১৯১২ সালে ৮ ঘণ্টা কাজের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া এবং ১৯২১ সালে নারী কর্মীদের মাতৃত্বকালীন বিশেষ সুযোগ-সুবিধাসহ একাধিক নীতি তৈরি করেছিলেন। জাহাঙ্গীর টাটা ১৯৩৮ সালে ৩৪ বছর বয়সে কোম্পানির চেয়ারম্যান হন এবং প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে এ পদে ছিলেন। একজন শিল্পপতি হওয়ার চেয়ে বিমানচালক হওয়ার বিষয়ে বেশি আগ্রহ ছিল তার। জাহাঙ্গীর টাটার এ আগ্রহ জন্মেছিল লুই ব্লেরাইটের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর। লুই ব্লেরাইট প্রথম বিমানচালক ছিলেন যিনি ইংলিশ চ্যানেলের ওপর দিয়ে বিমান উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। জাহাঙ্গীর টাটা প্রথম ভারতীয় ছিলেন যিনি ‘বম্বে ফ্লাইং ক্লাব’ থেকে বিমান ওড়ানোর প্রশিক্ষণ নেন। টাটার বিমান পরিচালনা কোম্পানি ‘এয়ার ইন্ডিয়া’ ভারত সরকার নিজের মালিকানায় নিয়ে নিলেও আবার সেই বিমান সংস্থাটি সরকারের কাছ থেকে কিনে নিয়েছে টাটা গোষ্ঠী। এয়ার ইন্ডিয়া ফিরিয়ে নেওয়ার পর টাটা সন্সের কাছে এখন তিনটি এয়ারলাইন্স রয়েছে।

কম্পিউটারের দুনিয়ায় প্রবেশ : পরিবারের ঐতিহ্য বজায় রেখে ১৯৬৮ সালে এমন একটি ব্যবসা শুরু করেন, যা সেই সময়ে শুধু উন্নত দেশগুলোয় প্রচলিত ছিল। এ ব্যবসা ছিল কম্পিউটার-সম্পর্কিত। ‘টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস’ বা ‘টিসিএস’ নামক এ সংস্থাটি বিশ্বে সফটওয়্যার সরবরাহ করে। বর্তমানে এটি টাটা গ্রুপের অন্যতম লাভজনক কোম্পানি।

টাটা গোষ্ঠীর সাফল্যের রহস্য : টাটা সন্স হলো মূল বিনিয়োগ হোল্ডিং কোম্পানি এবং টাটা কোম্পানিগুলির প্রবর্তক। টাটা সন্সের ৬৬ শতাংশ ইক্যুইটি শেয়ার ক্যাপিটাল এমন বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে। বিবিসি জানায়, টাটা গোষ্ঠী এখনো কোম্পানির সম্পদের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেনি। তবে ৩১ জুলাই ২০২৩ পর্যন্ত তারা তাদের সম্পদ ৩০ হাজার কোটি ডলার বলে ঘোষণা করে জানিয়েছিল, বিশ্বে তাদের ১০ লাখেরও বেশি কর্মী রয়েছেন। টাটার অসাধারণ সাফল্য সম্পর্কে অর্থনৈতিক বিশ্লেষক শঙ্কর আইয়ার বলেন, “আম্বানি বা আদানির নাম (প্রকাশ্যে) আসে কারণ তাদের সংস্থাগুলি ব্যক্তিগত। টাটা বিভিন্ন সংস্থার একটি গোষ্ঠী এবং একটি ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত হয়। তাই এ সংস্থাকে নিয়ে সেভাবে আলোচনা করা হয় না। ভারতে অনেক বিষয়ে টাটা গোষ্ঠীর মর্যাদা ‘মায়ের’ মতো।”

জিই ইন্ডিয়ার অ্যালস্টম ইন্ডিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বর্তমানে হয়সাং ইন্ডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাগেশ তিলওয়ানি বলেন, ‘টাটার বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো এর নৈতিক, ন্যায়যুক্ত এবং স্বচ্ছব্যবস্থা যা কর্মীদের সঙ্গে একটি শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করেছে।’ টাটা গোষ্ঠীর সাফল্য সম্পর্কে তিলওয়ানির জানান, মূলধন বিনিয়োগের প্রতি টাটার একটি সুস্পষ্ট দৃষ্টি এবং কৌশল রয়েছে, যার উপযুক্ত উদাহরণ হলো স্টারবাকস, ক্রোমা কনসেপ্ট এবং জাগুয়ার ব্র্যান্ড ইত্যাদি। এটি ‘ননসেন্স’ বিষয় এড়িয়ে চলে এবং শান্তভাবে মনোযোগ দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করে। তার মতে, টাটা গোষ্ঠী তাদের করপোরেট সোশ্যাল রেশপন্সিবিলিটির কথা মাথায় রেখে ‘ব্র্যান্ড পজিশনিং’ করেছে।

তিনি বলেন, ‘এ কারণে সারা দেশে ভোক্তারা তাদের সঙ্গে যুক্ত এবং তারা নিরাপদবোধ করেন। তাদের কাছে এ ব্র্যান্ডটি বিশ্বস্ত ও সৎ। আবেগপ্রবণ এবং অনুপযুক্ত ট্রেডিং সিদ্ধান্ত এড়ানো, ঝুঁকির ভারসাম্য বজায় রাখতে পোর্টফোলিও পরিবর্তন করা এবং অত্যন্ত স্পষ্ট পরিচালন পদ্ধতি এ শিল্পগোষ্ঠীর উত্তরোত্তর ব্যবসা ও পুঁজি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।’ টাটা পাওয়ারের নয়াদিল্লির প্রজেক্ট ম্যানেজার বিবেক নারায়ণ বলেন, ‘প্রথম দিকে জাগুয়ার অধিগ্রহণের সিদ্ধান্তকে বাজারে ভালো সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। কিন্তু পরে তা বেশ সফল বলে প্রমাণ হয়েছে। বিবেক নারায়ণ জানান, টাটার সাফল্যের গ্যারান্টি হলো এর বৈচিত্র্য। এ শিল্পগোষ্ঠী যে ক্ষেত্রেই কাজ করুক না কেন, তারা ইতিবাচক পরিবেশ আনার চেষ্টা করে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close