বিশেষ প্রতিবেদক
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ
পরিবহনে বেশুমার চাঁদাবাজি
নওগাঁ জেলার মান্দা থেকে সরিষা নিয়ে রাজধানীর সাভারের তামাবাজারে পৌঁছেন ট্রাকচালক বোরহান উদ্দিন। ৬ ঘণ্টার ২৪০ কিলোমিটার পথে ৫ স্থানে চাঁদা দিতে হয় তাকে। চাঁদার পরিমাণ কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা। নিয়মিত উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন বাজার থেকে পান, সবজি ও কাঁচামাল ঢাকায় পৌঁছান তিনি। পদে পদে চাঁদা দেওয়া ছাড়া চাকা নড়ে না ট্রাকের। অস্বীকার করলেই গলায় ধরে ছুরি, ভেঙে ফেলে গাড়ির গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ।
পরিবহনে চাঁদাবাজির শিকার এ চালক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, রাজশাহী অঞ্চল থেকে সবজি, পান ও দানাজাতীয় পণ্য; যেমন ধান, গম, সরিষা এসব নিয়ে ঢাকার মিরপুর-১, সাভার, বাইপাইল, গাবতলীসহ বিভিন্ন বাজারে পৌঁছে দেন। এসব পণ্য পরিবহনে ব্যবসায়ীর কাছে চুক্তি নিতে হয় তাকে। চুক্তি অনুযায়ী পণ্য পৌঁছানোর দায় ঘাড়ে আসে ড্রাইভার ও হেলপারের। চাঁদা না দিলে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় ট্রাকের ত্রিপল কেটে মালামাল বের করে নেওয়ার ঘটনা ঘটে হরহামেশাই।
দেশজুড়ে সড়কে চাঁদাবাজি চলছে। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন বিষয়টি চিহ্নিত করে সরকারের কাছে বারবার এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ও চাঁদাবাজির বিষয়ে অবহিত। তারাও তা বন্ধ করা হবে বলে বারবার আশ্বাস দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সচিব সভায়ও পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি শক্ত হাতে দমনের নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর বিভিন্ন স্থানে র্যাবের অভিযানে চাঁদাবাজদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এ চাঁদাবাজি বিভিন্ন কৌশলে দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশুমার চলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রমজানের আগেই বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে জোর দিতে হবে পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধের বিষয়ে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পরিবহনে চাঁদাবাজি চলছে। রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ, পরিবহন নেতারাও এ চাঁদাবাজি টিকিয়ে রেখেছেন। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান গতকাল বুধবার প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আমরা নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে তদারকি বাড়িয়েছি, উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি জোরদার করছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্নভাবে কাজ করছে। অভিযানও পরিচালনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের তথ্যানুসারে, সড়ক পরিবহন খাতে দিনে ১১ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন মালিকদের সঙ্গে আঁতাত করে দিনে ১১ লাখ গাড়ি থেকে ১১ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে। সে হিসাবে বছরে সড়কে ৪ হাজার ১৫ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। শ্রমিক লীগ সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ খোকন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, শ্রম আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে। পরিবহন শ্রমিকরা একটি মাফিয়া চাঁদাবাজ চক্রের হাতে নির্যাতিত হচ্ছে। শ্রমিকদের শোষণ করে চাঁদাবাজরা শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। রাজধানীর চারটি বড় টার্মিনালসহ দেশের প্রতিটি টার্মিনালের শ্রমিকরা এ মাফিয়া চক্রের হাতে জিম্মি। চাঁদাবাজদের দমনের জন্য শক্ত ও সাহসী উদ্যোগ দরকার।
সংশ্লিষ্ট গাড়িচালকরা জানান, সড়ক পরিবহন খাতে মূলত তিন পদ্ধতিতে চাঁদা তোলা হয়। তার মধ্যে আছে দৈনিক মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নামে চাঁদা, বাস-মিনিবাস নির্দিষ্ট পথে নামানোর জন্য মালিক সমিতির চাঁদা ও রাজধানী ও এর আশপাশে কোম্পানির অধীনে বাস চালাতে দৈনিক গেট পাস (জিপি) চাঁদা। জানা গেছে, সড়ক পরিবহনে সংগঠন পরিচালনা ব্যয় বা সার্ভিস চার্জের নির্দেশিকা তৈরি হয় ২০২০ সালে। সেই ব্যয়ের নামে চাঁদা আদায় হচ্ছে। নির্দেশিকায় একটি গাড়ি থেকে যদি দিনে দুবার ৫০ টাকা করে চাঁদা নেওয়ার কথা।
তবে প্রকৃতপক্ষে একটি গাড়িকে দিনে কমপক্ষে ২০টি স্থানে চাঁদা দিতে হয়। নির্দেশিকায় উল্লেখ করা আছে টার্মিনাল থেকে বেরোনোর সময় ৫০ টাকা দেবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সায়েদাবাদ থেকে একটি বাস পটুয়াখালী যেতে কমপক্ষে ২৫ স্পটে কমপক্ষে ৫০ টাকা করে দিচ্ছে। প্রণয়নকৃত নির্দেশিকাও মানা হচ্ছে না। পরিবহন নেতা হানিফ খোকন বলেন, এ ধরনের নির্দেশিকা প্রণয়ন করার এখতিয়ার সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর নেই। পরিবহনের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হলে প্রত্যেক বেসিক ইউনিয়নের নেতাদের সম্পদের হিসাব ও তাদের পরিবার-পরিজনের সম্পদের হিসাব নিতে হবে। বৈধ আয়বহির্ভূত সম্পত্তি থাকলে তা সরকারকে বাজেয়াপ্ত করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ-বিসিআই মনে করে, বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও খাদ্যের মুদ্রাস্ফীতি সবচেয়ে বেশি। তার অন্যতম কারণ পণ্য পরিবহনে বিভিন্নভাবে চাঁদা আদায়। পণ্য পরিবহনের চাঁদাবাজি বন্ধ করা গেলে পণ্যমূল্য অনেকটাই কমে আসবে। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি এ সংগঠনের সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরীর (পারভেজ) নেতৃত্বে সংগঠনের প্রতিনিধিদল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তারা পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করার জোর দাবি জানান। তখন চাঁদাবাজি বন্ধ করার আশ্বাস দিয়ে এ ব্যাপারে কাজ করছেন বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও জানান, ঢাকাসহ সারা দেশে নিত্যপণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণ পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি। ফলে বিভিন্ন স্থানে অভিযানও পরিচালনা করা হয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী; বিশেষ করে র্যাব কর্মকর্তারা দেখেছেন, পাইকারি ও খুচরা বাজারে সবজির মূল্যে তারতম্য আছে। পণ্য উৎপাদনের স্থান থেকে পাইকারি বাজারে তা পরিবহনকালে দেশের বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে ধাপে ধাপে চাঁদা দেওয়া হয়। ফলে পাইকারি বাজারে বেড়ে যায় সবজির দাম। তার খেসারত দিতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
র্যাব ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে মোবাইলকোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে সাময়িক নিত্যপণ্যের বাজার স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হলেও পরে আবার আগের মতো উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে নিত্যপণ্য। ট্রাকচালকরা জানান, পণ্যবাহী কোনো গাড়ি ঢাকায় ঢুকলেই লেজার লাইটের আলো নিক্ষেপ করে থামিয়ে চাঁদা আদায় করা হয়। বিভিন্ন স্থানে এজন্য চাঁদাবাজ চক্র সক্রিয় রয়েছে। বিশেষ করে মধ্যরাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পণ্যবাহী ট্রাক থেকে এ চাঁদাবাজি বেড়ে যায়। এ অবস্থায় গত ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে চাঁদা তোলার সময় ৩২ চাঁদাবাজকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১।
চট্টগ্রামেও চাঁদাবাজি হচ্ছে। চট্টগ্রাম নগরীর গুরুত্বপূর্ণ ৫০টি পয়েন্টে চাঁদাবাজি করছে বেশ কয়েকটি চক্র। তাদের লক্ষ্য পণ্যবাহী ট্রাক, যাত্রীবাহী বাস, মাইক্রোবাস, সিএনজি-অটোরিকশা। গত ৬ ফেব্রুয়ারি পণ্য ও যাত্রীবাহী পরিবহনে চাঁদাবাজির অভিযোগে চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। মহানগরীর চান্দগাঁও থানার কাপ্তাই রাস্তার মাথা, একে খান মোড়, বায়েজিদ থানার অক্সিজেন মোড় থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। আগাম তথ্য সংগ্রহ করার পর নাটোরে আলাদাভাবে তিনটি অভিযান পরিচালানা করে র্যাব। ট্রাক-বাস ও বিভিন্ন পরিবহনের চাঁদাবাজি করার সময় চক্রের মূলহোতাসহ ২৫ জনকে টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ৬ ফেব্রুয়ারি এ তথ্য জানান নাটোর র্যাব ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার সঞ্জয় কুমার সরকার।
জানা গেছে, মালিক-শ্রমিকদের কল্যাণের নামে সড়ক পরিবহনে বিপুল চাঁদা তোলা হয়। কিন্তু করোনাকালে কর্মহীন শ্রমিকরা অর্থ সহায়তা পাননি। ওইসময় পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি, বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ২০২১ সালের ৩১ মে যৌথ বৈঠক করে। পরদিন থেকে চাঁদা বন্ধের সিদ্ধান্ত হয় সভায়। ২০২০ সালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন চাঁদা না তোলার অঙ্গীকার করে। কিন্তু এসব অঙ্গীকার কাগজেই আছে, মাঠে চলে চাঁদাবাজি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী অবশ্য বলছেন, সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধে আমরাও চেষ্টা করছি। তবে পরিবহন সংগঠনের ব্যয়ের জন্য চার্জ নেওয়া হয়।
"