নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

জন্মনিবন্ধনের বাইরে কয়েক লাখ পথশিশু

রবিবার, ঘড়ির কাঁটা রাত ১২টার কাছাকাছি। রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের সামনে গাড়ি ছুটছে। রিকশার জন্য গাড়ি আটকে যেতেই জানালা ঘেঁষে দাঁড়াল একটি শিশু; বয়স বড়জোর বছর ৬ কিংবা ৭। কোমল কণ্ঠে তার আকুতি ‘ছ্যার কয়ডা ট্যাহা দেনা না, কিছু কিনা খামু।’ কিন্তু ততক্ষণে গাড়ি ছুটতে থাকে। সড়ক বিভাজকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে আবার কখন থামবে গাড়ি। কিছুক্ষণ পরে গাড়ি থামতেই এগিয়ে যায় সে। আর দেখা হয় না। পরে কমলাপুর স্টেশনে দেখা মিলে আরো কয়েকজনের সঙ্গে তাকে। জানা গেল নাম তার জীবন। তার মতোই শামসু, বারেক ও আকাশ। বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করতেই জীবন জানায় তার গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জে। ‘কী করে এলে কমলাপুরে? জবাবে বলে, সিলেট থেইকা আইছি কয়েক দিন আগে। আবার যামুগা।’

পড়াশোনা করে কি না জিজ্ঞেস করতেই তার তৎক্ষণাৎ জবাব ‘পড়ালেহা কইরা করমু কী?’ জানাল সিলেট স্টেশনেই থাকে সে। খাবারের পয়সা জোগাড় করে ভিক্ষার মাধ্যমে। মাঝে মাঝে সিলেট থেকে ট্রেনে করেই এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনে চলে যায়। এভাবে ভবঘুরের মতোই জীবন কেটে যায় তাদের। স্টেশনের প্ল্যাটফরমই রাত্রিযাপনের আশ্রয়স্থল। শুধু এই তিনজনই নয়, তাদের মতো লাখো পথশিশু আছে ঢাকায়।

আইনে স্পষ্ট বিধান থাকা সত্ত্বেও জন্মনিবন্ধনের বাইরে রয়ে যাচ্ছে এরা। মাঠপর্যায়েও কার্যকর পদক্ষেপ নেই। এতে রাষ্ট্রীয় নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা। ফলে তাদের সাধ আর সাধ্যের ফারাক থেকে যায় রেললাইনের মতোই, কী শৈশব, কী কৈশোর কিংবা বার্ধক্যে! শহরজুড়ে পরিচয়হীন ঘুরে বেড়ানো এসব শিশু, মৌলিক নাগরিক অধিকার কিংবা সামাজিক নিরাপত্তার সব সুরক্ষার বাইরে। কিন্তু কোনোভাবে, গায়ে-গতরে খেটেও ওরা একটু শিক্ষিত হয়ে উঠবে তারও সুযোগ নেই। কারণ জন্মসনদের আওতায় নেই তারা।

জীবন বলে, ‘জন্মনিবন্ধন নাইকা, এজন্য স্কুলে ভর্তি নেয় না। কিন্তু আমি জানি না, জন্ম নিবন্ধন কী?’

সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক (শিশু সুরক্ষা ও শিশু অধিকার বিভাগ) আবদুুল্লাহ আল মামুন বলেন, এই শিশুরা যখন জন্মনিবন্ধনের সুযোগ পাচ্ছে না, তখন তারা প্রথমেই বাংলাদেশের যে নাগরিক হওয়ার সুবিধা আছে তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

রাষ্ট্রের স্বীকৃত নাগরিকের সব সুযোগ-সুবিধা পেতে কিছু ক্ষেত্রে জন্মসনদ প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা পাসপোর্ট তৈরি, বিবাহ নিবন্ধন বা গ্যাস, পানি, টেলিফোন ও বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ-সুবিধায় দরকার জন্মনিবন্ধন সনদ।

জাতিসংঘের বিশেষ সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশের ১০ লাখ কিংবা ঢাকার ৭ লাখ পথশিশুই রাষ্ট্রীয় এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অথচ এ নিয়ে নেই আইনের কোনো ঘাটতি। ২০১৮ সালের জন্মণ্ডমৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালা বলছে, পরিচয়হীন শিশুর বাবা-মা, জন্মস্থান ইত্যাদি না পাওয়া গেলেও নিবন্ধন করতে বাধা দেওয়া যাবে না। অসম্পূর্ণ স্থানে অপ্রাপ্য লিখে নিবন্ধন করতে হবে।

পথশিশুদের নিয়ে ২০২২ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, সেখানেও তাদের জন্মসনদের বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

আইনজীবীরা বলছেন, আইন থাকার পরও মাঠপর্যায়ের নিবন্ধন কর্মকর্তাদের গাফিলতিতে ভুগছে পথশিশুরা।

আইনজীবী তাপস কান্তি বল বলেন, ‘যখন পথশিশুদের এই জন্মসনদ দেওয়া হচ্ছে না। তখন সে যেসব সামাজিক সুবিধা গ্রহণ করতে পারত, সেগুলো থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।’

এদিকে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় বলছে, এ বিষয়ে নিবন্ধন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও কার্যকর ফল আসছে না। আর এখন পর্যন্ত কতজন পথশিশু নিবন্ধনের আওতায় এসেছে সেই পরিসংখ্যানও নেই তাদের কাছে।

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘অবশ্যই সবশিশু জন্মনিবন্ধন পাওয়ার যোগ্য। এ রকম কোনো বিষয় নজরে আসেনি যে, আমাদের কোনো সংস্থা সুবিধাবঞ্চিত শিশুর জন্মনিবন্ধন অস্বীকার করেছে।’

সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, নাগরিক স্বীকৃতি পেলে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা ভবিষ্যতে মানবসম্পদে রূপান্তরিত হয়ে অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close