গাজী শাহনেওয়াজ

  ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

রাজধানীতে বায়ুদূষণ অতিমাত্রায়

ঢাকায় অতিমাত্রায় বায়ুদূষণ নিয়ে উদ্বিগ্ন দেশের পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। এ দূষণ নতুন নয়, বহু দিনের। কার্যকরী পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে রাজধানী ঢাকা মহানগরীতে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ২০২৩ সাল ছিল আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর বছর। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বায়ুমান সূচকে ঢাকার গড় নম্বর (স্কোর) ছিল ১৭১, যা আগের বছর ছিল ১৬৩। ক্যাপস বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আট বছরে ঢাকার বায়ুমান নম্বর চার বছর (২০১৬, ২০১৭, ২০১৯ ও ২০২০) সংবেদনশীল গোষ্ঠীর (শিশু, প্রবীণ) জন্য অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে ছিল। সর্বশেষ তিন বছরসহ বাকি পাঁচ বছর ছিল অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে। আর শক্তি ফাউন্ডেশন জানায়, ধুলাবালুর কারণে কাপড়টির রং কত দ্রুত বদলায়, তা দেখে বায়ুদূষণ পরিস্থিতি বোঝা যায়। শুধু ঢাকায় নয়, ভারতের নয়াদিল্লি, বেঙ্গালুরু, লক্ষ্মৌ, মুম্বাই ও লুধিয়ানা এবং নেপালের কাঠমান্ডুতে এর আগে এভাবে বায়ুদূষণ পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা হয়েছে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় বায়ুর মান বেশি খারাপ থাকে শীতে। বর্ষায় মোটামুটি গ্রহণযোগ্য থাকে। ক্যাপসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আট বছরে ২০২২ সাল ছাড়া প্রতি বছরই জানুয়ারি মাসে বায়ুর মান বেশি খারাপ ছিল। কম খারাপ ছিল জুলাই ও আগস্টে। এই দুই মাসে বৃষ্টি হয়। ফলে দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টি হলে ঢাকার মানুষ মোটামুটি নির্মল বায়ুতে শ্বাস নিতে পারে। বৃষ্টি চলে যাওয়ার পর অক্টোবর মাস থেকে দূষণ বাড়তে থাকে। ক্যাপসের বিশ্লেষণ বলছে, গত বছরের মার্চ, জুন, জুলাই, সেপ্টেম্বর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে আগের বছরের সংশ্লিষ্ট মাসের তুলনায় বায়ুদূষণ কম ছিল।

চলতি মাসেই টানা কয়েক দিন পরীক্ষায় ঢাকার বাতাসের মান ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। গত শুক্রবার সকাল ৮টা ২৪ মিনিটে ২৩৯ এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) স্কোর নিয়ে বিশ্বের দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ঢাকা। এর মধ্যে ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি বাতাসের একিউআই স্কোর ছিল যথাক্রমে ২৬৩, ২৫৭, ২৮৬, ২৩২, ২৮৮ ও ২৬৬। দীর্ঘদিন ধরে বায়ুদূষণে ভুগছে ঢাকা। এর বাতাসের গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায় এবং বর্ষাকালে কিছুটা উন্নত হয়। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলো। এদিকে গতকাল সোমবার বায়ুদূষণে বিশ্বের ১০০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান দশম। আইকিউএয়ারের বাতাসের মানসূচকে সকাল ৭টা ৫৩ মিনিটে ঢাকার স্কোর ছিল ১৫৬। এই স্কোর ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলে বিবেচনা করা হয়। চলতি মাসে টানা দুই দিন ঢাকার বায়ু ছিল দুর্যোগপূর্ণ। এ ছাড়া বেশির ভাগ দিনই ছিল অস্বাস্থ্যকর। বায়ুদূষণের এই পরিস্থিতি নিয়মিত তুলে ধরে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার। বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা এই লাইভ বা তাৎক্ষণিক একিউআই সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত, সেটা সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় এবং সতর্ক করে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্প নিলে অর্থ ব্যয় হবে। কিন্তু পুরোনো বাস উঠিয়ে নেওয়া, যানবাহনে কম দূষণকারী জ্বালানির ব্যবহার, দূষণকারী ইটভাটা বন্ধ করা, নির্মাণসামগ্রীর সঠিক ব্যবস্থাপনা ও শহরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর জোর না দিলে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাবেক সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বায়ুদূষণের কারণে ঢাকার মান খারাপ এটা নতুন না। এটা মোকাবিলা করার জন্য নির্মল বায়ু অ্যাক্ট প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আজ অবধি তা আলোর মুখ দেখিনি। এর পরিবর্তে একটি বিধিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে বায়ুদূষণ কমানোর অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে। কিন্তু কম্পিহেন্সিভ ও সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া ঢাকা বায়ুদূষণ কমানো সম্ভব না।

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, বায়ুদূষণ যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে তা আইওয়াশ ছাড়া কিছুই না। কারণ একক সরকারি সংস্থার সহায়তায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। যেটা করা হচ্ছে তা অপপ্রয়াস। দরকার বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা। কারণ বিছিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সরকার মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে অজ্ঞতা ও গুরুত্ব অনুধাবন না করার কারণে। ঢাকার পরিবেশ উন্নত করতে হলে অবশ্যই বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (সিপিআরডি) প্রধান নির্বাহী মো. শামসুদ্দোহা প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, অনেক আগে থেকেই ঢাকার বায়ুর মান অত্যন্ত খারাপ ছিল। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তা সবাইর সম্মুখে প্রকাশ পেয়েছে। এটা বাংলাদেশের জন্য অ্যালার্মিং। বায়ুদূষণ থেকে বাঁচা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য করণীয় কী জানতে চাইলে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, তিনটি করণীয় বিষয়ে সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে। এর প্রথমটি রাজধানীর ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো নিষিদ্ধ করে ডাম্পিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। অহরহ ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এগুলো সরকার জানে কিন্তু রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালী শ্রমিক নেতাদের কারণে আইনের প্রয়োগগুলো কার্যকর করতে ব্যর্থ হচ্ছে। দ্বিতীয়টি ঢাকার আশপাশের সব ইটভাটার কার্যক্রম থামিয়ে দিতে হবে। কিন্তু অবৈধ ইটভাটা বন্ধের জন্য বর্তমান পরিবেশমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। যা কারো কাম্য না। কারণ ইটভাটা থাকলে পরিবেশদূষণ হবে। আর তৃতীয়টি যত্রতত্র বাড়ি নির্মাণ ও রাস্তায় ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখার কারণে বায়ুদূষণ ঘটছে। এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ কমানো সম্ভব।

ঢাকার বায়ুদূষণ যে বাড়ছে, তা অস্বীকার করেননি পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক। তিনি বলেন, দূষণ যে বাড়ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দূষণের উৎসগুলোর মধ্যে আছে উপমহাদেশীয় দূষিত বায়ুপ্রবাহ, রান্নার ধোঁয়া, কলকারখানার ধোঁয়া, যানবাহনের দূষণ। উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা হচ্ছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close