প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে তার সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, স্বাধীন বিচার বিভাগ, শক্তিশালী সংসদ ও প্রশাসন একটি দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে পারে। ক্ষমতা গ্রহণের পর আমরা বিচার বিভাগকে প্রশাসন থেকে আলাদা করে সম্পূর্ণ স্বাধীন করেছি, যা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লক্ষ্য ছিল। গতকাল শনিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত দক্ষিণ এশিয়ার একবিংশ শতাব্দীর সাংবিধানিক আদালত : ভারত-বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা শীর্ষক দুদিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

উচ্চ আদালতের রায়ে সামরিক শাসন এবং সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখলকে অবৈধ হিসেবে রায় দেওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর যখন এ রায় এলো সেই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আবার গণতন্ত্রকে সুসংহত করি। আমাদের সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদ যেখানে বলা আছে, ‘এ প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ’ সেখানে আরেকটি অনুচ্ছেদ আমরা যুক্ত করে এ উচ্চ আদালতের রায় অনুসারেই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারি যে অপরাধি এবং সেটা যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সেটা আমরা সংযুক্ত করি। এর মাধ্যমে জনগণের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষিত করা হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আমরা আইন পাশ করেছি। এ নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। তাকে আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন করে দিয়েছি। বাজেটেও তাদের জন্য পৃথক বরাদ্দ দিয়েছি। এমনকি আগে বিচার বিভাগও আর্থিকভাবে নির্ভরশীল ছিল সরকারের ওপর। কিন্তু আমরা সরকারে আসার পর বিচার বিভাগকেও সম্পূর্ণ স্বাধীন করে দিয়েছি। প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ আলাদা করে দিয়ে সব ক্ষেত্রেই তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছি। আমরা এ বিষয়টা বিশ্বাস করি বলেই আমরা সেটা করতে পেরেছি, আওয়ামী লীগ সরকার করতে পেরেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৭৫-এ জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘদিন ক্ষমতা জনগণের হাতে ছিল না, ক্যান্টনমেন্ট বন্দি ছিল- এটাই হলো বাস্তবতা। আমি ধন্যবাদ জানাই সুপ্রিম কোর্টকে কেননা তারা যে আদেশটা দিয়েছিল, সেটাই আমাদের বেঁচে থাকার সুযোগ করে দেয়।

সরকারপ্রধান বলেন, মুন সিনেমা হলের মালিকানা নিয়ে একটা মামলা ছিল। মার্শাল ল’ অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে মালিকানা দেওয়া হয়েছিল অন্য কাউকে। যেটা নিয়ে আদালতে বিচার হয়। সেই বিচারের রায় দিতে গিয়েই সুপ্রিম কোর্ট এ মার্শাল ল’কে অবৈধ ঘোষণা করে। শুধু তা-ই নয়, সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল যে সম্পূর্ণভাবে অসাংবিধানিক এবং ছিল সেটা সেই ঘোষণাই জারি হয়, যা দেশের মানুষের জন্য নিশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দেয়। তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার সুযোগ এনে দেয়। আর এর মাধ্যমেই গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার সুযোগ করে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, মিলিটারি ডিক্টেটররা ক্ষমতায় এসে প্রথমেই রাজনীতিবিদদের গালাগাল করেছে। এরপর নিজেরাই রাজনীতিবিদ হয়ে গেছে, উর্দি ছেড়ে রাজনিতিবিদ সেজে দল গঠন করে নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে অবৈধ ক্ষমতা বৈধ করার জন্য সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এসে সেই অবৈধ ক্ষমতাকে বৈধ করার প্রয়াস পেয়েছে। সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী এভাবেই তৈরি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে একটি গণতান্ত্রিক ধারা বা পরিবেশ ছাড়া কখনো কোনো দেশের জনগণের আর্থসামাজিক উন্নতি সম্ভব নয়। ভারতবাসী সেদিক থেকে সত্যিই সৌভাগ্যবান যে তাদের দেশে ধারাবাহিক গণতন্ত্র চলেছে। হয়তো সরকার পরিবর্তন হয়েছে এবং বিরোধী মতালম্বীরাও রয়েছেন, কিন্তু গণতন্ত্র কখনো প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে আমাদের জীবনে তো এসেছে অমানিশার অন্ধকার। পাকিস্তান আমলে যে স্বৈরশাসন বলবৎ ছিল তা আবার ’৭৫-এর পরে টানা ২১ বছর স্বাধীন বাংলাদেশেও চলেছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানকেও এ সময় শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শেখ হাসিনা ৯০০ জনের অধিক বিচারক ভারতের ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাকাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ায় ভারত সরকার এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্টকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার ও সাংবিধানিক মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে বিভিন্ন কালজয়ী সিদ্ধান্ত প্রদান করেছে। আমাদের দুই বন্ধুপ্রতিম দেশ একই আইনের ও আইনি দর্শনের উত্তরাধিকারী হওয়ায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তগুলো আমাদের উচ্চ আদালত দৃষ্টান্ত বা রেফারেন্স হিসেবে গ্রহণ করার নজির আছে। তাছাড়া কমন-ল কান্ট্রিজ হওয়ার সুবাদে যেকোনো দেশ যে কারো রায়কে প্রিসিডেন্স হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি বিশ্বাস করি, এ ধরনের কনফারেন্স আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের মিথষ্ক্রিয়া বৃদ্ধি পাবে। আইনি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বিনিময়ের মাধ্যমে উভয় দেশের আদালত ও বিচার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সমৃদ্ধ হবেন। ফলে দুদেশের বিচার বিভাগের মধ্যে সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় আরোহণ করবে। আমি মনে করি, এ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে অদূর ভবিষ্যতে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে উন্নত বিচার প্রশাসন বিনির্মাণে দুদেশের মধ্যে একটি রোডম্যাপ তৈরি করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং ভারতের প্রধান বিচারপতি ড. ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড় বক্তব্য দেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি এম এনায়তুর রহিম স্বাগত বক্তব্য দেন। পরে বিকেলে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ‘বঙ্গবন্ধু অ্যাপ’ উদ্বোধন করেন। এতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। অ্যাপটি উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী বলেন, এতে জাতির পিতার বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জানার সুযোগ তৈরি হয়েছে। একইসঙ্গে আমাদের মহান স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ডিজিটাল প্ল্যাটফরম তৈরি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অ্যাপটি তৈরির মহতি উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট সবাইক ধন্যবাদ জানান।

"