প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
রুশ আগ্রাসনের দুই বছর পূর্তি
সংঘাতে ক্লান্ত ইউক্রেন তবু দেশ রক্ষার স্বপ্ন
* পূর্বাঞ্চলীয় শহর আভদিভকা গোলাবারুদের অভাবে হারিয়েছে ইউক্রেন * সেনা সংগ্রহে দেশবাসীর সাড়া পাচ্ছে না জেলেনস্কি প্রশাসন * ইউক্রেনের সেনাবাহিনী দেশেই উন্নত ড্রোন তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছে
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের দুই বছর পূর্তি হচ্ছে আজ। সম্প্রতি আভদিভকা শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর গত প্রায় ৯ মাসের মধ্যে প্রথমবারের মতো ইউক্রেন জয়ে আশাবাদী হয়ে উঠছে রাশিয়া। বিপরীতে কিয়েভের মনোবলে ফাটল ধরেছে, ইউক্রেনের সেনা পড়েছেন উন্নত অস্ত্রের ঘাটতিতে। তবু দেশ রক্ষার আশা জেগে আছে রাজধানী কিয়েভে, জাগছে মাতৃভূমি রক্ষার স্বপ্ন। এদিকে রাশিয়া আরো আক্রমণের অস্ত্র শানাচ্ছে জোর কদমে। কী ঘটবে এখন? এই প্রশ্ন ভাবিয়ে তুলেছে আমেরিকা ও পাশ্চাত্য বিশ্বকে। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণ অবলম্বনে এই প্রতিবেদন।
ইউক্রেনের দোনেৎস্ক অঞ্চলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত ৩৯ বছর বয়সি এক আর্টিলারি কমান্ডার, যার কলসাইন তিতুশকো। ইউক্রেনের গোলা-বারুদের ব্যাপক ঘাটতির মধ্যেই যুদ্ধরত এই সেনা তুলে ধরেছেন লড়াইয়ের সমস্যা আর সীমাবদ্ধতা। নভেম্বরে, ইউক্রেনের প্রথম ট্যাংক ব্রিগেডের আর্টিলারি বিভাগের অংশ ছিলেন তিতুশকোর সেনারা। তখন তারা প্রতি ১০ দিনে অন্তত ৩০০ শেল সরবরাহ পেত। ফলে প্রতি মুহূর্তে গুলি চালানো যেত। আর এখন তারা দিনে ১০টি গুলি চালাতে পারেন। তাও শুধু প্রতিরক্ষার জন্য।
এই ঘাঁটির আরেক সেনা জানিয়েছেন, তাদের বিভাগে গোলা-বারুদের সরবরাহ খুবই কম। যেগুলো আছে সেগুলো ইরানের তৈরি, যা হুথিরা উপসাগরে জাহাজ আক্রমণের কাজে ব্যবহার করে। প্রকৃত যুদ্ধক্ষেত্রে সেগুলোর ব্যবহার একেবারেই বোকামি। কারণ সেগুলো নিম্নমানের ও সমস্যাযুক্ত।
সম্প্রতি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ শহর আভদিভকা রুশ বাহিনী নিয়ন্ত্রণে নেয়। গত বছরের মে থেকে এ পর্যন্ত এটাই ছিল রাশিয়ার সবচেয়ে বড় বিজয়। আর এই ক্ষতিকে গোলা-বারুদের ঘাটতির সরাসরি পরিণতি হিসেবে বর্ণনা করেছেন ইউক্রেনের কর্মকর্তারা।
কিয়েভের সাংস্কৃতিক ইতিহাসবিদ নাটালিয়া ক্রাইভদা অবশ্য আভদিভকার পতনের জন্য ইউক্রেনের জাতীয় ঐক্যের অভাবকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, যেহেতু আমাদের রাষ্ট্রহীন জাতির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, তাই তখন মানুষ দায়িত্ব নিয়েছিল। তারা আদেশের অপেক্ষা করেনি। বরং যুদ্ধের প্রথম বছরে শক্তিশালী নতুন ইউক্রেনীয় পরিচয় তৈরি করতে প্রাণপণ লড়াই করেছে। কিন্তু সেই ঐক্যে এখন ফাটল ধরতে শুরু করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সম্প্রতি মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি দেশটির জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, গত দুই বছরে ইউক্রেনীয়রা কতটা অর্জন করেছিল। দুই বছর মানে ৭২৪ দিন। এই সময়ে ইউক্রেন জয় না পেলেও হেরে যায়নি।
কিন্তু যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকায়, সামরিক সরবরাহ কমে যাওয়ায়, মার্কিন আর্থিক সহায়তা স্থগিত ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগামীতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনায় ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে সেদেশর মানুষসহ পশ্চিমারা। ফলে ইউক্রেনে স্পষ্টতই দেখা দিয়েছে বিভাজন।
যুদ্ধের এই পর্যায়ে, স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যাবে এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে উঠছে। কারণ ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী বিজয়ী হতে পারে এবং দ্রুত সব হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধার করতে পারবে বলে তাদের কাছে মনে হচ্ছে না। কিয়েভ গত বছর থেকেই স্বেচ্ছাসেবী সেনা সংগ্রহের চেষ্টা করে যাচ্ছে। অনেকে স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনীতে নামও লেখাচ্ছে। কিন্তু এটাও সত্যি যে, যুদ্ধে যাওয়ার ভয়ে অনেকেই লুকিয়ে থাকছে বা পালিয়ে বেড়াচ্ছে বা অন্য দেশে আশ্রয় নিচ্ছে। কিয়েভের এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভলোদিমির ফেসেনকো বলেছেন, এ সময় আমাদের সংহতি প্রয়োজন। একেবারে সেনা সংগ্রহ না করে ধাপে ধাপে তা করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
এদিকে নতুন নিয়োগ পাওয়া সেনারা কতটা ভালোভাবে যুদ্ধ করতে পারবে, সেই প্রশ্নও রয়েছে। সেনাবাহিনীর একটি সূত্র জানায়, প্রশিক্ষণের সময় এক মাস থেকে বাড়িয়ে দুই মাস করার পরিকল্পনা চলছে, তবে সম্মুখ যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য এটিও খুব পর্যাপ্ত সময় নয়। আর্টিলারি ডিভিশনের ডেপুটি কমান্ডার ভ্যালেন্টিন বলেন, মানুষের আসলে বাড়ি এবং প্রিয়জনদের ছেড়ে দূরে থাকার অভিজ্ঞতা নেই। মৃত্যুভয় তো আছেই।
তবে এতসবের মাঝেও কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। নৌবাহিনী না থাকা সত্ত্বেও কৃষ্ণসাগরে আধিপত্য বজায় রেখেছে ইউক্রেন। এখনো যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়েনি তারা। দেশে ড্রোন তৈরির কাজও চলছে।
যদিও এগুলো যুদ্ধ জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস বাড়াচ্ছে না। কারণ যুদ্ধের তৃতীয় বছরে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দৃশ্যপটও ভেঙে যেতে পারে। প্রথম বছরের ঐক্য এখন আর নেই। জেলেনস্কির রাজনৈতিক বিরোধীরা ক্রমেই সোচ্চার হয়ে উঠছে। এই মাসের শুরুর দিকে জনপ্রিয় সেনাপ্রধান ভ্যালেরি জালুঝনিকে বরখাস্তের বিষয়টিও ইউক্রেনের ঐক্যের ঘাটতিকে তুলে ধরেছে।
এই বসন্তে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কথা ভাবা হচ্ছে। যদিও এই মুহূর্তে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রায় অসম্ভব। তবে উদ্বেগ রয়েছে যে, জেলেনস্কি জাতীয় ঐক্য হারাতে পারেন। যদিও ইউক্রেনীয়রা বুঝতে পারছেন যে, তাদের অভ্যন্তরীণ অশান্তি কেবল রাশিয়াকেই বিজয়ী করে তুলবে।
তারপরও যুদ্ধের তৃতীয় বছরটি ইউক্রেনের জন্য সবচেয়ে কঠিন হতে পারে। কারণ যুদ্ধের প্রথম বছরে পশ্চিমারা ভাবতে পারেনি যে, ইউক্রেন রাশিয়ার সামনে দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু তবু তারা শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে লড়াই চালিয়ে গেছে। দুই বছর আগে রাশিয়া আক্রমণ চালালে, খুব সামান্যই প্রতিরোধের সম্মুখীন হতো। কিন্তু এখন এটা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু অনির্দিষ্টকালের জন্য লড়াই করাও দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতি চুক্তির কথাও ভাবা হচ্ছে।
ফেসেনকো বলেছেন, যদি আমরা পরের বছরটিকে থাকতে পারি, তাহলে সম্ভবত এক ধরনের যুদ্ধবিরতির আলোচনা করতে বাধ্য হবো। কিন্তু এখানেও কিছু কথা রয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেনের সম্পূর্ণ পরাজয় এখনো রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য এক অসম্ভব স্বপ্নই বটে। কারণ এর আগেও রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করেছিল। আর ২০১৪ সালে ইউক্রেনের সঙ্গে ‘মিনস্ক শান্তিচুক্তি’ করেছিল। মূলত ওই চুক্তির ফলেই ৮ বছরের জন্য যুদ্ধ থেমে ছিল। কিন্তু রাশিয়া সেই চুক্তি ভঙ্গ করে ইউক্রেন আক্রমণ করে।
কিন্তু আবারও যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলে, রাশিয়া যে আবারও ইউক্রেন আক্রমণ করবে না, তার কোনো বিশ্বাস নেই। তিতুশকোর মতে, শান্তিপূর্ণ জীবনে ফিরে যাওয়ার পর, আবারও যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসা কঠিন। মস্কো তার কথা রাখবে, সেটা এখন আর কোনো ইউক্রেনীয় নাগরিকই বিশ্বাস করেন না। তাই এবার আমাদের ভালোর জন্যই তাদের শেষ করতে হবে। যুদ্ধে জিততে হবে।
"