নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

ঢাকায় বাড়িভাড়ায় নাভিশ্বাস

নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের মধ্যেই বাড়িভাড়া বৃদ্ধি ভোগাচ্ছে নগরবাসীকে। বছরের প্রথম দিন থেকে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায় বাড়ি বদলের চিত্র। এখনো কমবেশি চলছে। কেউ পিকআপে করে, কেউ ট্রাকে কিংবা ভ্যানগাড়িতে করে মালামাল নিয়ে অন্য এলাকায় চলে যাচ্ছেন। কী কারণে তাদের বাড়ি বদল? অধিকাংশই জানিয়েছেন- ভাড়া বেশি, কুলাতে পারছেন না। একটু দূরে শহরের প্রান্তিক এলাকায় চলে যাচ্ছেন তারা, যেখানে বাড়িভাড়া তুলনামূলক কম।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগের প্রধান মো. কামরুজ্জামান গতকাল বলেন, ঢাকা শহরের বাড়িওয়ালারা যখন খুশি তখন বাড়িভাড়া বাড়িয়ে দেন। গত বছর জানুয়ারিতে আমার বাড়িভাড়া ১ হাজার ৫০০ টাকা বাড়িয়েছিলেন, এর ৬ মাস পর ১ হাজার ৫০০ টাকা বাড়ান। আবার চলতি বছরের জানুয়ারিতে গ্যাস, পানি, লিফট, জেনারেটরের অজুহাতে ২ হাজার টাকা বাড়িয়েছেন। গত এক বছরে আমার বাড়িভাড়াই ৫ হাজার টাকা বেড়েছে। অথচ বেতন বাড়েনি। এগুলো দেখার কি কেউ নেই? এমন অবস্থা শুধু রাসেলের নয়, ঢাকায় যারা ভাড়া বাড়িতে থাকেন, তাদের প্রায় সবারই; বিশেষ করে নিম্নআয়ের মানুষের।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বাড়িভাড়া সূচকে (এইচআরআই) বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বাড়িভাড়া আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় শূন্য দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে। এই প্রবৃদ্ধি আগের প্রান্তিকের তুলনায় কম। তখন বাড়িভাড়ার গড় বৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৮১ শতাংশ।

আর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী গত ২৫ বছরে বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ এ সময়ে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ। সংগঠনটির আরেক পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০, ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা বাসাভাড়া পরিশোধে ব্যয় করেন।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে বাড়িভাড়া বৃদ্ধি ভাড়াটিয়াদের কাছে টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে উল্লেখ করে ক্যাবের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, কম ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ যখন খাবার ও খাবারবহির্ভূত পণ্যের বাড়তি দামের কারণে সমস্যায় ডুবে আছে, তখন বাড়িভাড়ার বাড়তি টাকা জোগাতে তারা অন্য খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছেন। আয় না বাড়ায় খরচ কমাতে অনেকে তাদের পরিবারের সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির চাপে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ধারদেনা করে চলার সুযোগও কমে গেছে। অনেকের কাছেই তাই খরচ কমানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় বসবাস করেন বেসরকারি চাকরিজীবী মাসুদ রানা। তিনি বলেন, ‘আমার বেতন অনুযায়ী বর্তমান ঊর্ধ্বগতির বাজারে সংসার পরিচালনা করা কঠিন। এরই মধ্যে অনেক কাটছাঁট করে কোনোমতে টিকে আছি। নতুন করে কাটছাঁট করার আর জায়গা নেই। তাই বাধ্য হয়ে বাসা ছেড়ে মূল শহরের একটু বাইরে বসিলার দিকে চলে যাচ্ছি। সংসার পরিচালনার জন্য এখন প্রতি মাসেই তিন-চার হাজার টাকা ঋণ করতে হয়।’

মিরপুরের বাসিন্দা সাব্বির আহমেদ। চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া থাকেন শেওড়াপাড়া এলাকার একটি বাসায়। তৃতীয়তলার সেই ফ্ল্যাটে ভাড়া দেন ১৪ হাজার টাকা।

বছরের শুরুতে তিনি বাড়ির মালিকের কাছ থেকে ভাড়া বাড়ানোর নোটিস পান। আগামী মাস থেকে ভাড়া বাড়বে এক হাজার টাকা। ফলে শুধু বাড়িভাড়া দাঁড়াবে ১৫ হাজার টাকা। সেই সঙ্গে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, ময়লার বিল সব মিলিয়ে যুক্ত হবে আরো প্রায় তিন হাজার টাকা। ১৮ হাজার টাকা লেগে যাবে। মাস শেষে তিনি বেতন পান ৩০ হাজার টাকা। এ টাকা থেকে ১৮ হাজার ভাড়া-বিলে চলে গেলে বাকি খরচ কীভাবে হবে? তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- দু-এক মাসের মধ্যে বাসা ছেড়ে দেবেন, চলে যাবেন আফতাবনগরের পেছনে একটু ভেতরের দিকে।

সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘আমার অফিস কারওয়ান বাজার। সেখান থেকে বেশ দূরেই (শেওড়াপাড়া) বাসাভাড়া নিয়েছিলাম কম খরচের জন্য। প্রথমে ১০ হাজার টাকায় উঠেছিলাম, কয়েক বছরে ভাড়া বেড়ে ১৪ হাজার টাকা হয়েছে। এখন আবার ১৫ হাজার টাকা করতে চায় মালিক। যেটা আমার পক্ষে বহন করা খুব কঠিন।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমান বাজারে সবকিছুর দাম এত বেশি যে প্রতি মাসেই চলে টানাপড়েন। এর মধ্যে বাসাভাড়া বাড়ানো... বাধ্য হয়ে এলাকা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আফতাবনগরের পেছনে ভেতরের দিকে ১১ হাজার টাকায় একটা বাসা দেখেছি, সেদিকেই চলে যাব। চলাচলে কষ্ট হবে কিন্তু কিছু করার নেই।’

এমন আরো কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জীবনযাত্রার ব্যয় ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশাহারা অবস্থা। সেই সঙ্গে বাড়িভাড়া বৃদ্ধিতে অসহায় হয়ে পড়েছেন মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষ। যে কারণে কম ভাড়ার আশায় একটু দূরে বাসা স্থানান্তরের প্রবণতা বেড়েছে।

দেশে বাড়ি নিয়ন্ত্রণের একটি আইন আছে, যেটি ১৯৯১ সালের। এই আইনে ভাড়াটিয়াদের স্বার্থ রক্ষার কথা বলা হয়েছে। আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। ভাড়াটিয়াদের স্বার্থ রক্ষার নানা বিষয় এখানে উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে আইনটির প্রয়োগ নেই। ঢাকা সিটি করপোরেশন ২০০৭ সালে শহরের ৭৭৫টি এলাকায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, কাঁচাবাড়ি, পাকা ঘর, সেমি পাকা, মেইন রোডের তিন শ ফিট ভেতরে এবং বাইরে ৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত প্রতি স্কয়ার ফিট ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু এটির প্রয়োগও কোথাও দেখা যায় না। এ ছাড়া ভাড়া বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১-এ রয়েছে সুনির্দিষ্ট বিধান। আইনের ১৬ ধারায় বলা হয়েছে, বড় কোনো ধরনের নির্মাণকাজ বা পরিবর্তন আনা ছাড়া বাসার মালিক দুই বছরের মধ্যে মূল ভাড়া বৃদ্ধি করতে পারবেন না।

বাড়িভাড়া বৃদ্ধির সমালোচনা করে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি মো. বাহারানে সুলতান বাহার বলেন, ‘নতুন বছর শুরু হলেই বা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণের কথা উল্লেখ করে নিয়মিত বাড়িভাড়া বাড়িয়ে আসছে বাড়ির মালিকরা। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন আছে, তবে কেউ মানে না। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর করতে আমরা বারবার সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি, নিজেরা মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছি। তবুও এই অসহায় ভাড়াটিয়াদের কথা কেউ শুনছে না।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close