বিশেষ প্রতিবেদক

  ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

ভুল পথে বিপুল বিনিয়োগ ঢাকা বিশৃঙ্খল-গতিহীন

দ্রুত গণপরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে মেট্রোরেল চালু করা হয়েছে। ঢাকা উড়ালসড়ক বা এক্সপ্রেসওয়েও চালু করা হয়েছে। একের পর এক আটটি উড়াল সেতু বা ফ্লাইওভারও রয়েছে। তারপরও কি ঢাকা মহানগরীর সড়ক গতিশীল?

গত আগস্টে প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের ১৫২টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে ধীরগতির শহর ঢাকা। দেশগুলোর ১ হাজার ২০০-এর বেশি শহরের মোটরযানের গড়গতি ওপর গবেষণা চালিয়ে ওঠে আসে এ তথ্য। গবেষণা পরিচালনা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চণ্ডএনবিইআর। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘দ্য ফাস্ট, দ্য স্লো, অ্যান্ড দ্য কনজাস্টেড : আরবান ট্রান্সপোর্টেশন ইন রিচ অ্যান্ড পুওর কান্ট্রিস’ শীর্ষক ওই গবেষণাটি করা হয়।

ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে কর্মরত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবকাঠামো নির্মাণে সরকার বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করলেও ভুল কৌশলের দরুন ঢাকার গতি বাড়ছে না। ঢাকা হাঁটছে। মানুষ সাধারণত ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার হাঁটতে পারে। ঢাকায় বাসের গতি তেমনই। তার বড় কারণ যানজট। সড়কে বিশৃঙ্খলার ফলে যানজট বাড়ছেই। যানজট নিরসনের অবকাঠামো করেও ফল মিলছে না।

পরিকল্পনা অনুসারে, প্রকল্প ও কর্মসূচি সময়মতো বাস্তবায়ন না হওয়া, ছোট গাড়ির নিয়ন্ত্রণহীন নিবন্ধন, সড়কে শৃঙ্খলার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ১৭ নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ঢাকার এই মরণদশা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা মতে, ২০০৪ সালে ঢাকায় গাড়ি চলাচলের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার; ২০১৮ সালে তা নেমে আসে সাত কিলোমিটারে। পরে তা আরো নিচে নেমেছে।

আন্তর্জাতিক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান নামবিও জানায়, ঢাকায় কোনো গন্তব্যে পৌঁছাতে ২৫ মিনিটের দূরত্ব অতিক্রম করতে গড়ে লাগে ৬৩ মিনিট। ঢাকায় যানজটের প্রধান কারণ ব্যক্তিগত গাড়ির আধিক্য। এটিকে বড় কারণ চিহ্নিত করেছে নামবিও। ঢাকার ২৬ শতাংশ সড়ক ব্যবহার করছে ব্যক্তিগত গাড়ি। এগুলোয় গড়ে দেড়জন করে যাতায়াত করে। ৪৯ শতাংশ সড়ক ব্যবহার করে বাস, যেগুলোয় গড়ে ৫০ জন করে যাতায়াত করে।

ঢাকার যানজট নিরসনে সরকার ১০ বছরের ব্যবধানে (২০০৯-২০১৯ সাল) বড় দাগে ৪২ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। ঢাকার সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা-আরএসটিপিতে বাস ব্যবস্থা সংস্কারকে অগ্রাধিকার দেওয়া হলেও তার আগেই ফ্লাইওভার বা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

এসটিপি প্রণয়ন করা হয়েছিল ২০০৪ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য। তাতে প্রাধিকার সুপারিশ ছিল ঢাকার ফুটপাত যাত্রীবান্ধব করা, ৫০টি সংযোগ সড়ক তৈরি করা, কোম্পানিভিত্তিক বাস পরিচালনা করা। এগুলো সময়মতো হয়নি। সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, ঢাকায় বাস ব্যবহার করেন ৬৫ শতাংশ যাত্রী। তারা পর্যাপ্ত বাস না পেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মোটরসাইকেলও চড়ছেন। তাতে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বাড়ছে।

ঢাকার সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ড. এস এম সালেহ উদ্দিন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বাস ব্যবস্থার সংস্কারের কাজ দেরিতে শুরু হয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে একাধিক রুটে তা চালু করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই বাস চলাচল ব্যবস্থা হোঁচট খেয়ে পড়ে আছে। ড. এসএম সালেহ উদ্দিন বলেন, ড. সালেহ উদ্দিন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ড. সালেহ উদ্দিন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, পাইলট হিসেবে কোম্পানিভিত্তিক বাস চলাচল প্রকল্প নেওয়াটাই ভুল হয়েছে।

বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, এসটিপির সুপারিশ অনুসারে, ফুটপাথ দখলমুক্ত করে কোম্পানিভিত্তিক বাস চলাচল, রিকশার বিচরণ ক্ষেত্র ও সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মতো মূল কাজ বাদ দিয়ে বিলাসী প্রকল্পের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। পদ্ধতিগতভাবে ভুল করা হয়েছে। ফলে বিনিয়োগ করে অবকাঠামো নির্মাণের সাময়িক ফল পাওয়া যাবে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ঢাকা বিশৃঙ্খলই রয়ে গেছে। ফুটপাত দখলমুক্ত করে মানুষের হাঁটার পরিবেশ তৈরি, ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা, পার্কিং ব্যবস্থাপনা- এসব কাজ আগে করা দরকার ছিল। তাতে ৩০ শতাংশ যানজট কমে অবকাঠামো নির্মাণের পরিস্থিতি তৈরি হতো। মূলে কাজ না করে ওপরে ওপরে কাজ করায় ফল মিলছে না সামগ্রিকভাবে। পরিবহনের মেরুদণ্ড হিসেবে কোম্পানিভিত্তিক বাস পরিচালনার ব্যবস্থা এখনো কার্যকর না হওয়াটা দুঃখকজনক। বাইসাইকেল লেনও কার্যকর নেই।

তিনি বলেন, এসটিপিতে দেড় যুগ আগে কোম্পানিভিত্তিক বাস পরিচালনার সুপারিশ করা হয়েছিল। এটি ছিল অগ্রাধিকার সুপারিশ। তা কার্যকর হয়নি। যখন যা করা উচিত তা না করে উল্টো বড় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তাও সময়মতো বাস্তবায়ন না হওয়ায় সমস্যার জট তৈরি হয়েছে। ঢাকায় পরিবহন ব্যবস্থাপনায় ৩২টি সংস্থা যুক্ত আছে। এসব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় নেই। ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ করা হয়েছে- এটির ক্ষমতা দেওয়া হয়নি সেভাবে।

এসটিপি প্রণয়নের জন্য সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করেছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক লুইস বার্জার গ্রুপ। ২০২৪ সালের মধ্যে ৩ কোটি ৬০ লাখ যাত্রীর পরিবহন চাহিদা পূরণ করার লক্ষ্যে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়নে সুপারিশ দেওয়া হয়েছিল তাতে। রাস্তার শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিত করা, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, অযান্ত্রিক যান ব্যবস্থাপনা, বৃত্তাকার নৌপথ চালু করা, পথচারী চলাচল ও নিরাপত্তা, পার্কিং নীতিমালা প্রণয়ন, পূর্ব-পশ্চিমমুখী সড়ক সম্প্রসারণের বিষয়টি তাতে গুরুত্ব পেয়েছিল। দ্রুত জনপরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে তিনটি মেট্রোরেল, তিনটি বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছিল। তিনটি মেট্রোরেলের মধ্যে এখন শুধু উত্তরা-মতিঝিল পথে একটি রুটে মেট্রো রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। এটি কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে।

বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট-বিআরটির তিনটি রুট নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। তার মধ্যে শুধু গাজীপুর-বিমানবন্দর রুটের কাজ চলছে। এটিও সময়মতো বাস্তবায়ন হয়নি। এসটিপি সংশোধন করে আরএসটিপি প্রণয়ন করা হয়েছে ২০১৫ সালে। তাতে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময়সীমা ১১ বছর বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ২০৩৫ সাল। অথচ ২০২৪ সালের মধ্যে এসটিপির সব সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা ছিল।

ঢাকায় যানজট না কমার বড় কারণ বাসের মতো গণপরিবহন না বাড়িয়ে ছোট গাড়ির নিবন্ধন বাড়ানো। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, ঢাকায় নিবন্ধিত বিভিন্ন ধরনের গাড়ির প্রায় অর্ধেকই মোটরসাইকেল। সবচেয়ে কম আছে বাস।

ঢাকায় সড়কে যানজট বেড়ে যাওয়া ও বিশৃঙ্খলার বড় কারণ হিসেবে মোটরসাইকেল বেড়ে যাওয়াকে চিহ্নিত করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, সড়ক নির্দিষ্ট, কিন্তু মোটরসাইকেলের চাপ প্রতিদিন বাড়ছে। এ জন্য ঢাকা মেট্রোর বাইরে অন্য জেলার মোটরসাইকেল ঢাকায় অ্যাপ ব্যবহার করে চলতে না দিতে আমরা বিআরটিএর কাছে প্রস্তাব করেছি।

বড় অবকাঠামো : ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এর বিমানবন্দর-ফার্মগেট অংশ যান চলাচলের জন্য চালু করা হয়েছে। প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১৩ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটারের এই মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩৩ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। ১৫ বছরে ৭টি ফ্লাইওভার করা হয়েছে ঢাকায়। এর মধ্যে আছে কালশী ফ্লাইওভার, বিমানবন্দর-মিরপুরে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার, মিরপুর-বনানী ফ্লাইওভার এবং বনানী ওভারপাস, কুড়িল বহুমুখী ফ্লাইওভার, বিজয় সরণি-তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল সংযোগ সড়ক ও রেলওয়ে ওভারপাস, তেজগাঁও-মগবাজার-মৌচাক-শান্তিনগর ফ্লাইওভার যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তানে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার। হাতিরঝিল-রামপুরা-বনশ্রী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ-শেখের জায়গা-আশুলিয়া-ডেমরা মহাসড়কের শেখের জায়গা থেকে আশুলিয়া হয়ে ডেমরা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার মহাসড়ক ১০৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। শিরনিরটেক থেকে গাবতলী সেতু পর্যন্ত ৯২ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ২ দশমিক ৬০ কিলোমিটার মহাসড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। ১২৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর মহাসড়কটি আট লেন করা হয়েছে। ৪৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকায় বিরুলিয়া-আশুলিয়া মহাসড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। ১৩০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ নবীনগর-ডিইপিজেড-চন্দ্রা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে।

হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ হয়েছে ২ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। পূর্বাচল সংযোগ সড়কের উভয় পাশে ১০০ ফুট প্রশস্ত খাল খনন ও উন্নয়নে লাগছে ১০ হাজার ৩২৯ কোটি টাকার বেশি। গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়নে ব্যয় হয় ৪১০ কোটি টাকার বেশি। মাদানী এভিনিউ থেকে বালু নদ পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও বালু নদ থেকে শীতলক্ষ্যা পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ (প্রথম পর্ব) প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছে ১ হাজার ২৫৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। মিরপুর-১০ থেকে কচুক্ষেত পর্যন্ত সড়ক প্রশস্ত ও উন্নয়ন, মিরপুর দারুস সালাম সড়ক নির্মাণ, ইসিবি চত্বর থেকে মিরপুর পর্যন্ত সড়ক উন্নয়ন ও কালশী মোড়ে ফ্লইওভার নির্মাণ ইত্যাদি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close