নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

গরমে বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো আরেক চ্যালেঞ্জ

আগামী মার্চ থেকে গরমের মৌসুম শুরু হবে। একই মাসে শুরু হবে রমজান ও সেচ মৌসুমও। এ কারণে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেড়ে যাবে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমে যাওয়ায় গরমে বিদ্যুৎবিভ্রাটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ কারণে গ্রীষ্মে বিদ্যুৎবিভ্রাট কমানোকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। চলতি মৌসুমে দৈনিক সর্বোচ্চ চাহিদা ১৭ হাজার মেগাওয়াট ছাড়ানোর পূর্বাভাস দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এ পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহের সক্ষমতা থাকলে ভাবনার কারণ হচ্ছে জ্বালানি ও ডলার সংস্থান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুল নীতির কারণে একদিকে যেমন গ্যাসের নিজস্ব (দেশের ভেতরে) উৎপাদন কমেছে; অন্যদিকে আমদানিনির্ভরতা বেড়েছে।

চলমান গ্যাস সংকটের প্রভাব এবার বিদ্যুৎ খাতেও পড়তে শুরু করেছে। আগামী গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা যখন বাড়বে, তখন এ সংকট আরো ব্যাপক আকার নিতে পারে বলেও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়ায় কিছু এলাকায় বিদ্যুৎবিভ্রাট দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে। আসছে গরমে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে, সেটা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। গরমকাল শুরু হওয়ার আগেই বর্তমান গ্যাস সংকটের সমাধান করতে না পারলে বিদ্যুতের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে।

বৈশ্বিক প্রতিকূল পরিস্থিতি, চলমান ডলার সংকট, পুঞ্জীভূত বকেয়া, গ্যাস-কয়লাসহ জ্বালানির ঘাটতি, এবং পায়রার মতো সবচেয়ে বড় ও নির্ভরযোগ্য কেন্দ্র বন্ধ থাকা এমন সব টালটামাল অবস্থার কারণে দেশের বিদ্যুৎ খাতকে গত দুই বছরই ধুঁকতে হয়েছে। ফলে চরম লোডশেডিংয়ে নাকাল হন সব প্রান্তের গ্রাহক। বছর ঘুরে আবারও যখন ঘনিয়ে আসছে গরম, তখন উঁকি দিচ্ছে সংকটের সংশয়। এবারও কি আগের তিক্ত অভিজ্ঞতা পাবেন ভোক্তারা? নাকি তুলনামূলক স্বস্তি পাবেন? ঘুরপাক খাচ্ছে এমন সব প্রশ্ন।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তামিম মনে বলেন, আমদানির ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাচ্ছি একটা স্থবিরতা আছে। ফলে এ মুহূর্তে কোনো স্বল্পকালীন সমাধান নেই। এ জ্বালানি সংকট যেটা, সেটা ডলারের সংকট না কাটলে স্বল্পকালীন কোনো সমাধান নেই। সরকারকে আগেভাগেই আসন্ন সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে।

আন্তর্জাতিক জ্বালানি পরামর্শক প্রকৌশলী সালেক সুফী বলেন, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন এবং পেট্রোবাংলার প্রচুর বকেয়া পড়ে রয়েছে। বর্তমানে পুরো সিস্টেমেই বেশ অস্থিরতা বিরাজ করছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, এলএনজির (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) ওপর যদি ব্যাপকভাবে নির্ভর করা হয়, তাহলে যে আর্থিক চাপ পড়বে, সেটি বাংলাদেশের এ ডলার সংকটের সময়ে বড় রকমের অসুবিধায় ফেলবে জ্বালানি বিভাগকে। সুতরাং আমাদের এ সমস্যা আসন্ন গ্রীষ্মে বড় আকারে হয়ে আসার পূর্বাভাস দিচ্ছে। কাজেই এখন থেকেই আমাদের উচিত হবে দেশীয় যেসব গ্যাসকূপ রয়েছে, সেগুলো থেকে উৎপাদনের মাত্রা সমানতালে রাখা বা সম্ভব হলে আরো বাড়াতে হবে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু জ্বালানি বিভাগের প্রায় ২.১ বিলিয়ন ডলার সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে গত ৭ ফেব্রুয়ারি বলেন, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তেল ও গ্যাসের সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে জ্বালানি নিরাপত্তা স্থিতিশীল রাখা বেশ দুষ্কর। দেশিয় প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান এবং উত্তোলন কার্যক্রম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তেল-গ্যাসসমৃদ্ধ দেশগুলোর সহযোগিতা নেওয়ার উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা যদি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে চাই, তাহলে সময়মতো অর্থের জোগান দিতে হবে। এটি নিয়ে আমরা পরিকল্পনা করছি। আমরা এরই মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা আশাবাদী যে ভালো অবস্থানে থাকব। এরই ধারাবাহিকতায় সংকটময় পরিস্থিতিতে জ্বালানি আমদানি স্বাভাবিক রাখতে ইসলামিক ট্রেড ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইটিএফসি) সঙ্গে ২১০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি করেছে জ্বালানি বিভাগ।

গরম, রমজান এবং সেচ মৌসুমের কারণে আগামী মাস থেকেই পাল্লা দিয়ে বাড়বে বিদ্যুতের চাহিদা। বিদ্যুৎ বিভাগের পূর্বাভাস, আগেরবারের তুলনায় প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট বেড়ে চলতি মৌসুমে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা দাঁড়াতে পারে ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। গত মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৬ হাজার মেগাওয়াট। তবে ১১ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ চাহিদা বাড়লেও জ্বালানি সংস্থানে রাতারাতি বড় কোনো পরিবর্তন দৃশ্যমান নয়। তার ওপর আরেক ভাবনার কারণ ডলার নিয়ে টানাটানি। এবার সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজন ১ লাখ ৫৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েল, ১৫ হাজার ৬০০ টন ডিজেল এবং দৈনিক কয়লার চাহিদা ৩০ হাজার টন। তার জন্য লাগবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার ছাড়। এছাড়া এবার বিদ্যুৎ বিভাগের দৈনিক চাহিদা ১৫৪ থেকে ১৭৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস। যেখানে গতবার বিদ্যুৎ খাতে ১১০ থেকে ১২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস জুগিয়েই হাঁপিয়ে যায় জ্বালানি বিভাগ। সে কারণেই এবার সংশ্লিষ্টদের কপালে চিন্তার ভাঁজ।

এ কারণে কৌশলী কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোতে না পারলে সাম্প্রতিক বছরের মতো চলতি মৌসুমেও সংকটে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে জ্বালানি বিভাগের। দেশে পরিচালিত গ্যাস-বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রায় ২০ শতাংশ জ্বালানিই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। আমদানিকৃত এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশনের পর পাইপলাইনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। এ লক্ষ্যে কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল রাখা হয়েছে, যেগুলো ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট বা এফএসআরইউ নামেই বেশি পরিচিত। সংস্কারের কারণে জাহাজ দুটির একটি গত নভেম্বর থেকে সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। আর কারিগরি ত্রুটির কারণে সম্প্রতি অন্যটি থেকেও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এতে আকস্মিকভাবেই জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ কমে যায়। বিশেষ করে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে গ্যাসের সরবরাহ প্রায় পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে যায়। পাশাপাশি ঐ এলাকার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয়ও এর প্রভাব পড়ে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close