গাজী শাহনেওয়াজ
হেলপার-ঝাড়ুদারের হাতেও ফেরির স্টিয়ারিং!
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোশনের (বিআইডব্লিউটিসি) আয়ের উৎসগুলোর মধ্যে লাভজনক ফেরি। অথচ খুবই অবহেলায় পরিচালিত হয়ে আসছে এ যানটি। কর্তৃপক্ষের গা ছাড়া ভাবের কারণেই এই খাতে সৃষ্টি হয়েছে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। এদিকে দুর্গম ও স্রোতবহমান নদীতে নৌযান দুর্ঘটনা রোধে চড়া বেতনে নিয়োগ করা হয় ইঞ্জিন কক্ষের ড্রাইভার এবং নৌযান পরিচালনার মাস্টার। অভিযোগ রয়েছে, বেশি বেতন নিলেও কাজে অবহেলা আছে এ দুজনের। তারা ফেরির স্টিয়ারিং হেলপার ও ঝাড়ুদার হাতে তুলে দিয়ে বাসায় থাকেন মাস্টার-ড্রাইভার। ফেরি দুর্ঘটনায় পতিত হয়। অন্যদিকে অতিমুনাফার জন্য ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত পণ্য পরিবহন করানো হয় লক্কড়-ঝক্কড় ফেরিতে। পরে অধিক ওজনের চাপ সামলাতে না পেরে গভীর নদীতে তলিয়ে যাচ্ছে ফেরি। এছাড়া হাতুড়ে চালকদের হাতে স্টিয়ারিং থাকায় স্রোতের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে অবজ্ঞার কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে।
ফলে প্রশ্ন উঠছে, ফেরি আসলে কে চালায়! মাস্টার-ড্রাইভার নাকি হেলপার-ঝাড়ুদার। প্রাপ্ত তথ্য মতে, সর্বশেষ রজনীগন্ধা নামে একটি ফেরি পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে ডুবে যাওয়ার পর টনক নড়েছে কর্তৃপক্ষের। ফেরিগুলো কারা পরিচালনা করছে নজরদারিতে আনতে ফেরি মাস্টার ও ড্রাইভারের কক্ষে বসানো হচ্ছে গোপন ক্যামেরা (সিসিটিভি)। কর্তৃপক্ষ বলছে, এতে প্রধান কার্যালয়ে বসে তদারকি করা যাবে ফেরি চলাচলের গতি-প্রকৃতি। পাশাপাশি ফেরিতে গাড়ি উঠানোর জায়গা থাকলেও ধারণক্ষমতাপূর্ণ হলেই গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে ফেরি। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে শাস্তির সম্মুখীন হবে দায়িত্বরত ফেরির কর্তাব্যক্তিরা। ধারণক্ষমতাসম্পন্ন যন্ত্রও বসানো হচ্ছে ফেরিতে। আর নৌ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিলম্ব হলেও ইতিবাচক উদ্যোগ নেওয়ায় সাধুবাদ জানায় নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কর্মকর্তাদের। বলেন, শুধু সিসিটিভি বসিয়ে দায় সারলে হবে না। চালাতে হবে কঠোর নজরদারি। অপরাধ করলেই চাকরি থেকে স্থায়ী বরখাস্ত এবং শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে, তাহলেই সচেতন হবেন দায়িত্ববানরা। খবর নৌ সূত্রের।
বিআইডব্লিউটিসিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সংস্থাটির সাতটি রুটে ফেরি চলাচল করছে ৪৩টি। চলাচলের উপযোগী ফেরির সংখ্যা ২০ থেকে ২৫টি; যেগুলো ২০১০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে কেনা হয়েছে। নতুন ফেরিগুলো দুই ক্যাটাগরির; যার একটি কে টাইপ, এই ফেরিতে একসঙ্গে সর্বোচ্চ ছোট-বড় ১৬টি গাড়ি নদী পার করা যাবে। আর ইউটিলিটি ক্যাটাগরিতে একসঙ্গে ১৪টি গাড়ি পার করা যাবে। এর বাইরে মান্ধাতার আমলের আরো ৫৩টির মতো ফেরি রয়েছে। সেগুলোও দেশের বিভিন্ন রুটে চলছে। ওই পুরোনো ফেরিগুলো কয়েক ক্যাটাগরির; যার মধ্যে রো রো ফেরি, স্মলফেরি, ইউটিলিটি ফেরিসহ কয়েক ধরনের রয়েছে।
চলাচলরত রুটগুলো হলো- পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া দুই প্রান্তের দূরত্ব তিন কিলোমিটার। একই ভাবে, আরিচা-কাজিরহাটের দূরত্ব ১৯ কিমি, শিমুলিয়া-বাংলাবাজারের ১১ কিমি, শিমুলিয়া-কাজিরকান্দি ৯ কিমি, হরিণাঘাট-চাঁদপুর-শরীয়তপুর ১০ কিমি, ভোলা-লক্ষ্মীপুর ২৮ কিমি ও লাহারহাট-ভেদুরিয়া ১০ কিমি।
এসব রুটে ফেরিগুলো চলাচল করলেও কর্তব্যরত মাস্টার ও ড্রাইভাররা সঠিকভাবে ডিউটি করেন না। দায়সারাভাবে চলার কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে ফেরির দুর্ঘটনা। কারণ অধীনস্থ কর্মচারীদের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় গিয়ে আরামে ঘুমান কিংবা দিনের অধিকাংশ সময় পারিবারিক কাজে মগ্ন থাকেন।
দুর্ঘটনা ঘটার পর অনিয়মগুলো নিয়ে শুরু হয় হইচই। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর কিছুদিন আলোচনা-সমালোচনা ও তোলপাড় চলে। সময়ের পরিক্রমায় দুর্ঘটনায় নিহত স্বজনদের আহাজারি বন্ধ হয়ে যায়। আবার পুরোনো ধারায় ফিরে যায় ফেরির দায়িত্বরত কর্তাব্যক্তিরা। টিসির বর্তমান চেয়ারম্যান অতীত-বর্তমান কর্মকাণ্ডগুলো যাচাই-বাছাই করে কিছু ত্রুটি নিরসনে উদ্যোগ নিয়েছেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। এর মধ্যে ফেরির ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত পণ্য পরিবহন না করার জন্য ব্যানার-ফেস্টুন দিয়ে জন সচেতনামূলক প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি ফেরির মাস্টার ও ড্রাইভারের কক্ষে সিসি ক্যামেরা এবং ওজন নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জানতে চাইলে টিসির চেয়ারম্যান ড. এ কে এম মতিউর রহমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ফেরি পরিচালনার সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের কিছু গাফিলতি রয়েছে বলে অভিযোগ আসে আমাদের কাছে। আমরা ওই অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখার চেয়ে তাদের জবাবদিহির মধ্যে আনতে বিশেষ করে মাস্টার ও ড্রাইভার কক্ষে গোপন ক্যামেরা বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রতিটি ক্যামেরার পেছনে খরচ হতে পারে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। এগুলো সঠিকভাবে স্থাপন করা সম্ভব হলে কে ফেরি চালাচ্ছে তা কর্মস্থলে বসেই দেখা যাবে। এর মাধ্যমে তারা স্বচ্ছতার মধ্যে চলে আসবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
এদিকে, দায়িত্বরতদের অবহেলার কারণে ফেরিতে দুর্ঘটনা ঘটছে নিয়মিত বিরতিতে। বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শীত মৌসুমে রাতে ঘন কুয়াশার মধ্যেও নির্বিঘ্নে ২০১৬ সালে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০টি ফেরিতে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ফগ লাইট বসানো হয়। একেকটি ৭ হাজার কিলোওয়াটের লাইট কিনতে ৫০ লাখ টাকার বেশি ব্যয় হয়। বলা হয়েছিল, এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। অথচ কয়েক দিন পরই অধিকাংশ লাইট নষ্ট হয়ে যায়। এই নৌরুটের খান জাহান আলী, শাহ আলী, কেরামত আলী, ভাষা শহীদ বরকত, কপোতি, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমীন, বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর, শাহ আমানত ও শাহ পরান ফেরিতে ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইট বসানো হয়। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে ছোট-বড় ১৬টি ফেরি চলাচল করে।
এসব ফেরিত প্রতিদিন ১৭০০ থেকে ১৮০০ যানবাহন পারাপার হয়। কিন্তু শীত মৌসুমে কুয়াশার কারণে প্রতিদিনই ৩ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্তও ফেরি চলাচল বন্ধ থাকছে। এসব কারণে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে প্রায়ই ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। এতে একদিকে ঘটছে প্রাণহানি, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসায়ীরা।
গত ১৭ জানুয়ারি সকালে কুয়াশায় আটকে থাকা ছোট ইউটিলিটি ফেরি ‘রজনীগন্ধা’র তলা ফেটে পানি উঠে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ার ৫ নম্বর ফেরিঘাটের অদূরে ৯টি ট্রাক নিয়ে ডুবে যায়। ডুবে যাওয়া রজনীগন্ধা ফেরিরও ফিটনেস ছিল না বলে অভিযোগ রয়েছে। এর আগে, ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর ‘আমানত শাহ’ নামের একটি ফেরি ১৭টি যানবাহন নিয়ে দৌলতদিয়া থেকে ছেড়ে পাটুরিয়ার উদ্দেশে গেলে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ার ৫ নম্বর ফেরিঘাটের কাছে ডুবে যায়। সেই ফেরিও ফিটনেসবিহীন ছিল। ফেরিটি প্রায় ৪১ বছরের পুরোনো ছিল। সর্বশেষ ২০১২ সালে ডকিং মেরামত হয়েছিল আমানত শাহ ফেরির। এরপর থেকে কোনো ফুল ডকিং করা হয়নি। এছাড়া কোনো সার্ভে সার্টিফিকেট ছিল না ফেরির। ফলে ফেরিটি চলাচলের অনুপযুক্ত ছিল।
জানা গেছে, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটের অধিকাংশ ফেরির বয়স ৩৫ বছরের বেশি। রজনীগন্ধার বয়স ছিল ৪৭ বছরের বেশি। রোরো ফেরি ‘খান জাহান আলী’ তৈরি হয় ১৯৮৭ সালে। আরেক রোরো ফেরি ‘কেরামত আলী’ ৩৬ বছরের পুরোনো। ‘বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর’ ফেরি তৈরি হয় ১৯৯২ সালে। এই সংস্থার আওতাধীন ৫৩ ফেরির মধ্যে ৪৭টিরই সনদ নেই। বেশির ভাগ ফেরি ৪০ বছরের বেশি পুরোনো। এছাড়া ১৮টি রোরো ফেরির (বড় ফেরি) মধ্যে ১৪ টিরই ফিটনেস সনদ নেই। বেশির ভাগ ফেরিতে নেই প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি। অনেক ফেরির বয়স ৪০ বছর পার হয়ে গেছে। আইন অনুযায়ী ৪০ বছরের বেশি বয়সি নৌযানের ফিটনেস সনদ দেয় না বাংলাদেশ নৌ পরিবহন অধিদপ্তর। তারপরও চলছে ফেরি সার্ভিস। ফলে মাঝে মধ্যেই ঘটছে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।
ফিটনেসবিহীন ফেরি চলছে বছরের পর বছর, বাড়ছে দুর্ঘটনা। কয়েকজন ফেরি মাস্টার জানান, প্রতিটি ফেরির বয়স ৩৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (বাণিজ্যিক) এস এম আশিকুর রহমান প্রতিদিনের সংবাদকে, ফেরিগুলো পরিচালনা নিয়েই নানা অভিযোগ রয়েছে। কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে তার কিছু কারণ আমরা খুঁজে পেয়েছি। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি। ফেরির মাস্টার ও ড্রাইভারকে জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে। অপেক্ষা করুন জানতে পারবেন।
সূত্র মতে, ফেরি শুধু টিসির রয়েছে তা নয়। সড়ক ও জনপথের কিছু পুরোনো ও লক্কর-ঝক্কর ফেরি রয়েছে। সওজ ও বিআইডব্লিউটিসি সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল-পিরোজপুর জেলা মহাসড়কের বেকুটিয়া, বরিশাল-মুলাদী জেলা সড়কের মীরগঞ্জ ও বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কের লেবুখালীসহ ১৮টি পয়েন্টে ফেরি চলাচল করছে। সওজ বিভাগের ১৭টি পয়েন্টে পরিচালিত ২৬ ফেরির মধ্যে ২৪টির অবস্থাই জরাজীর্ণ। মাত্র দুটি নতুন ফেরি রয়েছে সওজের ফেরি ডিভিশনের। এছাড়া বাকি চারটি পয়েন্টে ফেরি পরিচালনা করছে বিআইডব্লিউটিসি।
সওজ ও বিআইডব্লিউটিসি পরিচালিত অধিকাংশ ফেরির নেই অত্যাধুনিক সরঞ্জাম। এজন্য তীব্র স্রোতের কারণে প্রায়ই মাঝনদীতে বিকল হয়ে পড়ে। অনেক সময় ঘন কুয়াশার কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। বরিশাল-বাবুগঞ্জ-মুলাদী-হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ সড়কের মীরগঞ্জ পয়েন্টে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ ওজনের বৈদ্যুতিক খুঁটিবাহী একটি ট্রাক ফেরির গ্যাংওয়ের ওপরে ওঠে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। এতে পেছনে ছিটকে পড়ে পল্টুনসহ ট্রাকের অর্ধেক নদীতে নিমজ্জিত হয়। এছাড়া গত নভেম্বরে চট্টগ্রাম-লক্ষ্মীপুর-ভোলা-বরিশাল-মোংলা-খুলনা মহাসড়কের বেকুঠিয়া পয়েন্টের কঁচা নদীতে কয়েকটি বাস ও ট্রাক নিয়ে পারাপারের সময় জ্বালানিবাহী নৌযানের সঙ্গে সংঘর্ষে সওজের একটি ফেরির তলা ফেটে যায়। ওইসময় চালক দ্রুত নিকটবর্তী একটি চরে ফেরিটি তুলে দেন। এতে বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া গেলেও নৌযানটি ডুবে যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মীর তারেক আলী প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ফেরির মাস্টার ও ড্রাইভারকে নজরদারিতে রাখতে যে সিসি ক্যামেরা বসানোর চিন্তা করেছে কর্তৃপক্ষ তা ইতিবাচক। শুধু ক্যামেরা বসিয়েই দায় সারলে চলবে না। সেগুলোর যথাযথ তদারকি রাখতে হবে। কিছুদিন পরপর পরীক্ষা করতে হবে ক্যামেরা সচল না অকেজো হয়ে পড়ে আছে। কথায় আছে না, সরকারি মাল, দরিয়া কে ঢাল। এসব যেন না হয়, সেদিকেই খেয়াল রাখতে হবে।
"