নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

পাঠ্যবইয়ে ভুল যাচাই করছে এনসিটিবি

এবারও পাঠ্যবইয়ে শতাধিক ভুল * শিক্ষাবিদরা বলছেন, বইয়ে ভুলের বিষয়ে লেখক ও সম্পাদককে দায় নিতে হবে * ৫৮-৬০ পৃষ্ঠায় বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ অনুচ্ছেদের সঙ্গে বাংলা উইকিপিডিয়ার ‘বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ’ অংশের হুবহু মিল পাওয়া গেছে

‘পাঠ্যবইয়ে ভুল’ যেন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এবারও পাঠ্যবইয়ে শতাধিক ভুল পেয়েছেন তারা। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে যোগ হয়েছে বিভিন্ন সাইট বা ব্লগ থেকে কপি করার প্রবণতা। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পাঠ্যবইয়ের বিভিন্ন ভুল এবং কনটেন্ট নিয়ে দেশব্যাপি আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) মার্চে ভুল যাচাই করে সংশোধন দেওয়ার কথা জানিয়েছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, বইয়ে ভুলের বিষয়ে লেখক ও সম্পাদককে দায় নিতে হবে। পাশাপাশি বই লেখা ও সম্পাদনায় আরো সতর্ক থাকতে হবে। গত বছর থেকে দেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের বই যায়। চলতি বছর গেছে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। এসব বইয়ের মধ্যে বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরের বইয়ে ভুলের পরিমাণ বেশি। বানানের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির বাংলা বানান রীতি অনুসরণের কথা বলা হলেও অনেক বানানেই সেই নীতি অনুসরণ করা হয়নি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নবম শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠবইয়ের দশম পৃষ্ঠায় নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র ও তার ব্যাখ্যায় গাড়ির ত্বরণের মান ভুল দেওয়া হয়েছে। একইভাবে ২১ নম্বর পৃষ্ঠায় তরলের ভেতরে চাপের ধারণা দিতে গিয়ে পারদের জন্য চাপের মান ভুল দেওয়া হয়েছে। ৩২ পৃষ্ঠায় অনুর গতি ও তাপমাত্রা অংশে সেলসিয়াস, কেলভিন ও ফারেনহাইটের মধ্যে তাপমাত্রার যে সম্পর্ক দেখানো হয়েছে, তা ভুল। ৩৬ নম্বর পৃষ্ঠায় কঠিন পদার্থের প্রসারণ অংশে ক্ষেত্রফলের পরিবর্তন হিসেবে যে মান দেখানো হয়েছে, তা-ও ভুল। ৪১ নম্বর পৃষ্ঠায় ক্যালরিমিতি অংশে কাচের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করার যে প্রয়োজনীয় তাপ দেখানো হয়েছে, সেটিও ভুল।

এই শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের দ্বিতীয় পৃষ্ঠার প্রথম লাইনে হাট লেখা হলেও তৃতীয় লাইনে( ঁ) যোগ করে হাঁট লেখা হয়েছে। ২৩ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে এ দেশটির স্বাধীনতার পেছনে রয়েছে লক্ষ্য মানুষের আত্মদান। এখানে লক্ষ্য এর জায়গায় হবে লক্ষ বা লাখো। ২৮ নম্বর পৃষ্ঠার প্রথম অনুচ্ছেদে লড়াইয়ের না লিখে লেখা হয়েছে লড়ায়ের। ৩৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ভাষণগুলোতে না লিখে লেখা হয়েছে ভাষণগুলোর। একই পৃষ্ঠায় লক্ষ্যকে লক্ষ লেখা হয়েছে। ৩৬ নম্বর পৃষ্ঠায় র‌্যাডক্লিফকে লেখা হয়েছে র‌্যাডাক্লিফ। ৩৮ নম্বর পৃষ্ঠায় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের গঠনকাল লেখা হয়েছে ১৯৬০ সাল। মূলত এটির গঠন নিয়ে দুটি সালের তথ্য পাওয়া যায়। এগুলো হলো ১৯৬১ ও ১৯৬২ সাল। ৪৪ নম্বর পৃষ্ঠায় স্বাধীনতা লাভের পর যে সময়কালের ঘটনা বর্ণনা হয়েছে, সেখানে বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী/রাষ্ট্রপতি হিসেবে লেখা হয়েছে। তিনি কী ছিলেন, তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। ৫৪ নম্বর পৃষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণকে লেখা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ্য। একই পৃষ্ঠায় সাম্রাজ্যের-কে সাম্রাজ্যর এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রান্জ ফার্দিনান্দকে লেখা হয়েছে যুবরাজ ফারডিনাগু। ৫৯ নম্বর পৃষ্ঠায় সংবাদ সম্মেলনকে লেখা হয়েছে সাংবাদ সম্মেলন। ৫৮-৬০ পৃষ্ঠায় বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ অনুচ্ছেদের সঙ্গে বাংলা উইকিপিডিয়ার ‘বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ’ অংশের হুবহু মিল পাওয়া গেছে। ১০০তম পৃষ্ঠায় সবার ওপর মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই- এটি মধ্যযুগের কবির লেখা উল্লেখ করা হলেও সেই কবি বড়ু চণ্ডীদাসের নাম উল্লেখ নেই।

এই শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি বইয়ের ভূমিকায় সহযোগিতাকে ‘সহযোগীতা’ লেখা হয়েছে। ‘পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়’- বাক্যটি ১৫ বার ব্যবহার করা হলেও ১৩ বারই ‘পৃখিবী’ লেখা হয়েছে। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিকের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানিক, পাকিস্তানকে লেখা হয়েছে পকিস্তান।

অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ২৩ পৃষ্ঠায় প্রকৌশলী ফজলুর রহমান খানের মৃত্যু সাল দুটি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমে জন্মণ্ডমৃত্যু (১৯২৯-১৯৮২) লেখা হলেও পরবর্তী সময়ে ১৯৮৩ লেখা হয়েছে। তিনি মূলত ১৯৮২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ৪০তম পৃষ্ঠায় ষষ্ঠকে লেখা হয়েছে ‘ষষ্ট’। ৫৩ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ‘ত্রয়োদশ০০ সাল’। ৮২ নম্বর পৃষ্ঠায় কিলোমিটারকে লেখা হয়েছে ‘কীলোমিটার’। ১০৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ৩০ লাখ শিশু শ্রমিকের কথা বলা হয়েছে। যদিও গত বছরের জুলাইয়ের হালনাগাদ অনুযায়ী দেশে শিশু শ্রমিক ৩৫ লাখ। ১২১ নম্বর পৃষ্ঠায় চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বাম পাশে তার শিল্পকর্ম মোনালিসার অবস্থান লেখা হয়েছে, এটি হবে ডান পাশে। ১৩০ নম্বর পৃষ্ঠায় ঝুঁকিকে ‘ঝুঁঁকী’ লেখা হয়েছে। ১৫৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ঝুঁঁকিপূর্ণকে লেখা হয়েছে ‘ঝুঁঁকীপূর্ণ’।

একই শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে সুস্থ বানান লেখা হয়েছে ‘সুস্থ্য’। বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের ফিল্ড ট্রিপ অধ্যায়ে (৬৪ পৃষ্ঠা) খরগোশ ও কচ্ছপের গল্পের মধ্যে দৌড় প্রতিযোগিতার যে গাণিতিক সমাধান চাওয়া হয়েছে, সেটিকে ভুল বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মত হলো, এক ঘণ্টায় তিন কিলোমিটার প্রতিযোগিতার জন্য যে আদিবেগ ও ত্বরণের মান দেওয়া হয়েছে, তাতে খরগোশ ঘণ্টায় ১৩ কিলোমিটার যেতে পারবে।

মাদরাসা স্তরের ষষ্ঠ, সপ্তম, নবম ও দশম শ্রেণির ‘কাওয়াইদুল লুগাতুল আরাবিয়্যাহ’ বইয়ের মলাটে এসব শ্রেণির আরবি নামের ক্ষেত্রে ব্যাকরণগত ভুল করা হয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান বলেন, এটি মারাত্মক ভুল।

অষ্টম শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে ‘কৈশোরের কথামালা’ অধ্যায়ে কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক পরিবর্তনের এবং নবম শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ‘আপন আলোয় আলোকিত হই’ অধ্যায়ে যৌন সম্পর্ক, শারীরিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় আলোচনায় এসেছে। শিক্ষাবিদরা শিক্ষার্থীদের শারীরিক পরিবর্তনের এ বিষয়গুলো আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোকে স্বাগত জানালেও যে ভাষায় তা উপস্থাপন করা হয়েছে, তা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন।

নবম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ের ‘মিলেমিশে নিরাপদে বসবাস’ নামক অধ্যায়ের ১৪৯ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘নগর বসতি’ শিরোনামের পাঠে একটি মানচিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে লেবানন, সিরিয়া, সামারা, জেরিকা, জুড়িয়া, ইসরায়েল, জেরুজালেম, গাম্বিয়া, মিসর, জর্ডান নামক স্থানের অবস্থান দেখানো হয়েছে। বইটিতে দাবি করা হচ্ছে, এ মানচিত্রটি প্রাচীন জেরিকো নগরের অবস্থান নির্দেশ করছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এই বইয়ে প্রাচীন জেরিকো নগরের অবস্থানসংবলিত যে মানচিত্রটি দেখানো হয়েছে, তা সঠিক নয়; বরং জেরিকো নগরীর অবস্থান নির্দেশ করতে গিয়ে মানচিত্রে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সময়কালের স্থানকে নির্দেশ করা হয়েছে। তা ছাড়া মানচিত্রে গাম্বিয়া নামে যে স্থানটিকে নির্দেশ করা হয়েছে, সেখানে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া নয়, রয়েছে ফিলিস্তিনের গাজার অবস্থান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান বলেন, এটি দায়বদ্ধতার প্রশ্ন। সম্পাদনা যারা করেন, তাদেরও বিষয়টি যত্নের সঙ্গে দেখা উচিত।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নাদিম মাহমুদের মতে, নবম শ্রেণির অনুসন্ধানী পাঠ বইটির অনেক বিষয় আংশিক বা হুবহু নেওয়া হয়েছে মিসরভিত্তিক সফটওয়্যার কোম্পানি প্রাক্সিল্যাবস ডটকমের ব্লগ, ভারতীয় কোচিং সেন্টার বাইজুস (ইুলঁ’ং)-এর ওয়েবসাইটসহ অন্য উৎস থেকে। বইটির ইংরেজি সংস্করণ (ভার্সন) তৈরিতেও ‘গুগল ট্রান্সলেটর’ ব্যবহৃত হয়েছে। বইটির সিংহভাগ চিত্রের কনসেপ্ট ইন্টারনেট থেকে হুবহু নিয়ে পুনঃচিত্রায়ন করে বইটিতে ছাপানো হয়েছে।

নবম শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ বইটির রচনা ও সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এ বিষয়ে তিনি বলেন, এগুলো নিয়ে কথা বলে গুরুত্ব বাড়ানোর কিছু নেই। গত বছর নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে লেখা সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের একটি অংশে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এডুকেশনাল সাইট থেকে নিয়ে হুবহু অনুবাদ করে ব্যবহার করার অভিযোগ সত্য বলে দায় স্বীকার করে নেন বইটির রচনা ও সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত থাকা অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক হাসিনা খান।

একই লেখককে দিয়ে অনেক বই লেখানোর ফলে ভুল বেশি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, প্রতিবছর পাঠ্যবইয়ে ভুল দেখতে পাচ্ছি। যারা সম্পাদনার দায়িত্বে আছেন, তারা ঠিকমতো কাজ করলে বারবার ভুলের বিষয়টি আসত না।

এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, মার্চের শুরুতে এসব সংশোধনী যেতে পারে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close