অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

  ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ

আসন্ন রমজান মাসে পণ্যের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষকে যেন দুর্ভোগে না ফেলেন, সেজন্য নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠনের পর ইশতেহারের ঘোষণা অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের ওপর। সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। যেকোনো মূল্যে মূল্যস্ফীতি কমানোর তাগিদ দিয়েছেন সরকারপ্রধান।

প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্দেশনা পেয়ে তৎপর হয়েছে উঠেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলো। রমজান মাস সামনে রেখে নিত্যপণ্যের বাজারে লাগাম টানতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে তারা। এসবের মধ্যে রয়েছে পণ্য আমদানি, অবৈধ মজুদদার ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান এবং আমদানি পণ্যের কর ও শুল্ক কমানো। এরই মধ্যে চাল, চিনি ও খেজুরের ওপর শুল্ক কমিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সেইসঙ্গে ভোজ্যতেলের মূল্য সংযোজন কর প্রত্যাহার করা হয়েছে। অস্থির নিত্যপণ্যের বাজার। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় কিছুটা স্থিতিশীল হলেও নতুন সরকার দায়িত্ব পরপরই চড়তে শুরু করে বাজারের উত্তাপ। প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে চাল, ডাল, মাছ, মাংস, ডিম, তেল, পেঁয়াজের মতো ভোগ্যপণ্যের দাম। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ঠুনকো অজুহাতে দফায় দফায় বাড়াচ্ছেন জিনিসপত্রের দাম। বিপাকে সাধারণ মানুষ। অবশ্য সরকারও এবার খড়গহস্ত।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন জানান, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কঠোর নজরদারি করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। অনেক সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে চাঁদাবাজির প্রসঙ্গ আসে। এটির ক্ষেত্রে তিনি সংশ্লিষ্ট সবাইকে খুবই শক্তভাবে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। পণ্য পরিবহনের ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি বন্ধসহ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মাঠে নামানো হয়েছে। পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণেও কাজ করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। র‌্যাবের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে চাঁদাবাজ, মজুদদার এবং দ্রব্যমূল্যের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে সরকার দ্রব্যমূল্যের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এছাড়া আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করবেন। অনেকে বলছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে কোনো পূর্ণমন্ত্রী না থাকায় প্রধানমন্ত্রী নিজেই এ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী। ফলে মন্ত্রণালয় পরিদর্শন তার রুটিন কাজের অংশ। রমজানের আগে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজে গতিশীলতা এবং সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিতেই প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যাবেন।

এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর আলাদা আলাদা প্রজ্ঞাপনে চার পণ্যের বিভিন্ন পর্যায়ের শুল্ক কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। এনবিআরের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সেদ্ধ ও আতপ চাল আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে সেদ্ধ ও আতপ চাল আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বা রেগুলেটরি ডিউটি ২৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ সুবিধা চাল আমদানিকারকরা পাবেন আগামী ১৫ মে পর্যন্ত। তবে এ সুবিধা পেতে আমদানির প্রতিটি চালানের বিপরীতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার লিখিত অনুমোদন লাগবে।

তেলের ক্ষেত্রে দেশে পরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের উৎপাদন ও ব্যবসা পর্যায়ের মূল্য সংযোজন কর বা মূসক বা ভ্যাট পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ পরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের উৎপাদন ও ব্যবসা পর্যায়ে আপাতত ভ্যাট দিতে হবে না এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের। তবে এ সুবিধা তারা পাবেন আগামী ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। এছাড়া বিদেশ থেকে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন তেল এবং পাম তেল আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি পর্যায়ের ১৫ শতাংশ ভ্যাট কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। তার মানে সয়াবিন ও পাম তেলের আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট কমানো হয়েছে। আমদানিকারকরা এ সুবিধা পাবেন ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত।

এদিকে রোজার অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুর আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমানো হয়েছে। বর্তমানে খেজুর আমদানিতে শুল্ক ২৫ শতাংশ। রমজান মাস সামনে রেখে সেটি কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। খেজুর আমদানিকারকরা ১০ শতাংশ কম শুল্কে আমদানির এ সুবিধা পাবেন আগামী ৩০ মার্চ পর্যন্ত। এছাড়া পরিশোধিত ও অপরিশোধিত উভয় ধরনের চিনি আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে প্রতি টনে আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১ হাজার টাকা করা হয়েছে, আগে যা ছিল দেড় হাজার টাকা। আর পরিশোধিত চিনি আমদানিতে টনপ্রতি আমদানি শুল্ক কমিয়ে করা হয়েছে ২ হাজার টাকা, আগে যা ছিল ৩ হাজার টাকা। এনবিআর জানায়, পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে এ শুল্ক ছাড় পাওয়া যাবে ৩১ মার্চ পর্যন্ত।

প্রয়োজনে জরুরি আইন প্রয়োগ করে বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ হস্তশিল্প প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বাংলাক্রাফট) সভাপতির নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এবার একটু আমাদের ওপর আস্থা রাখেন। আগে যেভাবে সরকারের পক্ষ থেকে বলার পরও দাম কমেনি সেটা আর হবে না। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমেরও দায়িত্বশীল হতে হবে।’ বাজার নিয়ন্ত্রণে এসব পদক্ষেপ নেওয়ায় সাধুবাদ জানিয়েছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, সরকারের যে সদিচ্ছা, তা বাস্তবায়নের জন্য সমন্বিত বাজার তদারকির কাজ করতে হবে। তবেই সরকার সফল হবে। মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আসবে।

সরকারের কঠোর পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দাম বাড়ায় মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের লোকজন চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে। তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমাতে সরকার কঠোর পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে তা দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দেন তিনি। পাশাপাশি আমদানিনির্ভর সব নিত্যপণ্যের মজুদ মনিটরিংয়ের আওতায় এনে সরকারিভাবে মজুদ বাড়াতে হবে বলে জানান তিনি। বলেন, সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিলে অসাধু ব্যবসায়ীরা কারসাজি করার সাহস পাবে না।

গোলাম রহমান বলেন, আগের অর্থমন্ত্রী মনে করতেন, দেশের অর্থনীতির জন্য মূল্যস্ফীতি ভালো। কিন্তু এখনকার অর্থমন্ত্রী মুদ্রাস্ফীতি কমানোকে গুরুত্ব দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও এ প্রতিশ্রুতি রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলছে। তিনি বলেন, শুধু ধরপাকড় কিংবা জরিমানা করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এজন্য পলিসি অ্যাকশন দরকার। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ফিসকেল পলিসি, মনিটরিং পলিসির মতো যেসব সর্বজন স্বীকৃত ব্যবস্থা রয়েছে- এগুলো যদি নেওয়া হয়, পাশাপাশি বাজার তদারকি জোরদার করা হয়, তাহলে সুফল মিলবে। অনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য কেউ বেআইনি কাজ করলে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুততার সঙ্গে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তাহলেই বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close