নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৪ জানুয়ারি, ২০২৪

পানির ৫ রকম দাম ধরতে চায় ওয়াসা

ঢাকা ওয়াসা গত ১৪ বছরে ১৪ বার পানির দাম বাড়িয়েছে। এবার ঢাকার বাসিন্দাদের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী পানির দাম নির্ধারণ করতে চায় সংস্থাটি। সেক্ষেত্রে পানির ৫ রকম দাম নির্ধারণ করবে ওয়াসা। এরই মধ্যে ঢাকা ওয়াসার কারিগরি সমীক্ষায় বর্তমান দামের তুলনায় শ্রেণিভেদে ২৪ থেকে ১৪৭ শতাংশ পর্যন্ত পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে নিম্ন-মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত- সব শ্রেণির গ্রাহকের পানিতে খরচ বাড়বে।

ঢাকা ওয়াসার দাবি, উৎপাদন খরচের তুলনায় গ্রাহককে কম দামে পানি দেওয়া হচ্ছে। প্রতি ইউনিট (১ হাজার লিটার) পানিতে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ১০ টাকা। এই ভর্তুকি কমিয়ে সংস্থার লাভ বাড়াতে পানির দাম সমন্বয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী নতুন পানির দাম কার্যকর করতে চায় সংস্থাটি।

ঢাকা ওয়াসা কয়েক বছর ধরেই গ্রাহকের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী পানির দাম নির্ধারণের পরিকল্পনা করছে। বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের একটি বক্তব্যে। গত রবিবার ঢাকা ওয়াসা ভবনে এক অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেছেন, ভর্তুকি দিয়ে ঢাকায় ধনাঢ্য এলাকায় পানি সরবরাহ উচিত নয় বলে আমি মনে করি।

বর্তমানে আবাসিক গ্রাহকদের জন্য ঢাকা ওয়াসার প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাইকে এই হারে পানির বিল দিতে হয়। আর বাণিজ্যিক গ্রাহকদের প্রতি হাজার লিটার পানির বিল দিতে হয় ৪২ টাকা। ঢাকা ওয়াসার প্রতি ইউনিট পানির উৎপাদন খরচ নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। ২০২২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ওয়াসা ভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান বলেছিলেন, পানির উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রয়মূল্যের মধ্যে অনেক ব্যবধান। প্রতি ১ হাজার লিটার পানির উৎপাদন খরচ গড়ে ২৫ টাকা। বিক্রি করা হচ্ছে ১৫ টাকায়।

তবে ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পানির উৎপাদন খরচের যে তথ্য ঢাকা ওয়াসার এমডি দিচ্ছেন, তা বাস্তবসম্মত নয়। ২৫ টাকা উৎপাদন খরচ ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে পরিশোধন করা পানির। কিন্তু বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানির ৭০ ভাগই গভীর নলকূপ বা ভূগর্ভস্থ উৎসের। বাকি ৩০ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে পরিশোধন করা। গভীর নলকূপের পানির উৎপাদন খরচ অনেক কম। সে হিসেবে প্রতি এক হাজার লিটার পানিতে ১০ টাকা ভর্তুকির বিষয়টি সঠিক নয়।

এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ) এ কে এম সহিদ উদ্দিন বলেন, ‘উৎপাদন খরচের সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত। সব উৎসের পানির একটি গড় খরচ ধরা হয়। যেটা বলা হচ্ছে, সেই ২৫-২৬ টাকা প্রতি ইউনিটের উৎপাদন খরচ।’

ঢাকা ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক উত্তম কুমার রায় বলেন, ‘যত তাড়াতাড়ি করা যায়, আমরা দাম সমন্বয় করতে চাই। তবে দাম নির্ধারণে কয়েকটি ধাপ ও প্রক্রিয়া রয়েছে। সমীক্ষায় যে প্রস্তাব ছিল, তা নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। ঢাকা ওয়াসার গ্রাহকদের সুবিধা-অসুবিধা মাথায় রেখেই দাম নির্ধারণ হবে।’

ঢাকার বাসিন্দাদের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী পানির দাম নির্ধারণ করতে এরই মধ্যে এলাকাভিত্তিক পানির মূল্য নির্ধারণবিষয়ক টেকনিক্যাল স্টাডি (কারিগরি সমীক্ষা) করেছে সংস্থাটি। নিম্ন-আয়ের মানুষ, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত- এই পাঁচ শ্রেণিতে ভাগ করে পানির দাম নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি।

ওয়াসার প্রস্তাবে প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম নিম্ন-মধ্যবিত্তদের জন্য ১৮ টাকা ৭৫ পয়সা, মধ্যবিত্তদের জন্য ২৫ টাকা, উচ্চমধ্যবিত্তদের জন্য ৩১ টাকা ২৫ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আর উচ্চবিত্তদের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৭ টাকা ৫০ পয়সা। এ ছাড়া বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার বাণিজ্যিক গ্রাহকদের প্রতি হাজার লিটার পানির জন্য ৪২ টাকা দিতে হয়। নতুন করে শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রতি হাজার লিটার পানির দাম ৫০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

সমীক্ষাসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আর্থিক সামর্থ্যরে শ্রেণিবিভাজনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-২০০০ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। যারা ২৫০০ বর্গফুটের বেশি আয়তনের বাসায় থাকেন, তারা উচ্চবিত্ত; ১৫০০ থেকে ২৫০০ বর্গফুটের বাসায় যিনি থাকছেন, তিনি উচ্চমধ্যবিত্ত; ১০০০ থেকে ১৫০০ বর্গফুটের বাসায় বসবাসকারী মধ্যবিত্ত এবং ১০০০ বর্গফুটের নিচে বসবাসকারীদের নিম্ন-মধ্যবিত্ত হিসেবে ধরা হয়েছে। আর বস্তির বাসিন্দাদের নিম্ন-আয়ের মানুষ হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

এদিকে নগরবিদদের দাবি, ঢাকা ওয়াসা দিনে যত পানি উৎপাদন করে, তার ২০ শতাংশই কাগজে-কলমে ‘সিস্টেম লস’ (কারিগরি অপচয়)। কোনো প্রতিষ্ঠানে ৫ শতাংশের বেশি সিস্টেম লস অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার প্রমাণ। ওয়াসার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পানির অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে টাকা নেন। সিস্টেম লসের এ অপচয় কমানো গেলে ওয়াসাকে পানির দাম বাড়াতে হতো না।

ঢাকা ওয়াসার পানির দাম নির্ধারণে অস্বচ্ছতা রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি নগরবিদ আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ধনী-গরিব কারো ওপরেই অযৌক্তিক ব্যয়ভার চাপানো উচিত নয়। ঢাকা ওয়াসার অস্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা নীরব থাকেন। অস্বচ্ছতা দূর করলে পানির দাম বাড়ানো লাগে না। ওয়াসা একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, পানির দাম নির্ধারণে বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close