নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৪ জানুয়ারি, ২০২৪

শীতে বোরো ও সবজি নিয়ে দুশ্চিন্তায় চাষি

* কনকনে ঠাণ্ডায় শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না * হলুদ বর্ণ ধারণ করছে বোরো বীজতলা * পলিথিন মুড়িয়ে বীজতলা রক্ষার চেষ্টা

মাঘের শীতে কাঁপছে সারাদেশ। সঙ্গে ঘন কুয়াশা ও শৈত্যপ্রবাহে ক্ষতির মুখে বোরো ধানের বীজতলা। এসব বীজতলা এখন হলদে বর্ণ ধারণ করেছে। একই সঙ্গে নষ্ট হচ্ছে শাকসবজির খেতও। কনকনে শীতে কৃষিশ্রমিকের অভাব দেখা দিয়েছে। এসব কারণে ফসলের খেত নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন চাষিরা। অপরদিকে, ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস কিংবা এর নিচে নেমে গেছে দেশের অধিকাংশ এলাকার তাপমাত্রা। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী এসব এলাকার স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে সিরাজগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গায়। এছাড়া হাসপাতালগুলোয় বাড়ছে শীতজনিত কারণে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও। এদের বেশিরভাগই শিশু ও বয়স্ক মানুষ।

কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে কনকনে শীত, ঘন কুয়াশা আর শৈত্যপ্রবাহে বোরো চাষ নিয়ে দুশ্চিন্তায় এখানকার কৃষক। গত সোমবার সকাল ৬টায় জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের দিন রবিবার ছিল ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বলে জানিয়েছেন কুড়িগ্রামের রাজারহাট আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার। রাজারহাটে গতকাল সর্বনিম্ন ছিল ৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

শীত বাড়ায় বোরো চাষের জন?্য কৃষিশ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। উপজেলার পাইকেরছড়া গ্রামের কৃষক কফিল উদ্দিন জানান, ৩ বিঘা জমি পানি-সার দিয়ে চাষ করে প্রস্তুত করেছি। কিন্তু দুই দিন ধরে চারা লাগানোর শ্রমিক পাচ্ছি না। জমির পানি শুকিয়ে গেলে পুনরায় সেচ দিয়ে চাষ করতে হবে। এতে খরচ আরো বাড়বে। পশ্চিমছাট গোপালপুর গ্রামের কৃষক আবদুস ছাত্তার জানান, হাইব্রিড ধানের চারা ৪০ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে লাগাতে হয়। কিন্তু শ্রমিক না পাওয়ায় ধান লাগাতে পারতেছি না। চারার বয়স বেড়ে যাচ্ছে এবং শীতে হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল জব্বার জানান, মাসের শেষের দিকে তাপমাত্রা বাড়লে তখন সব স্বাভাবিক হবে। কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত জানান, আপাতত ফসলের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা নেই। শৈত্যপ্রবাহ দীর্ঘস্থায়ী হলে ক্ষতি হতে পারে।

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার হেরাপটকা গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, কয়েকদিনের প্রচণ্ড শীত ও ঘন কুয়াশায় ক্ষতি হচ্ছে বোরো ধানের বীজতলাসহ বিভিন্ন সবজি। এতে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। রাতে ফসলে কুয়াশা পড়ে। ভোরে মাঠে গিয়ে সে সব কুয়াশা সরিয়ে দিতে হয়। শীতের এ সময়ে কুয়াশার কারণে বোরো ধানের বীজতলায় লালচে রং ধারণ করেছে। একই এলাকার কৃষক রহমত আলী বলেছেন, গত আমন মৌসুমে ধানের নেক ব্রাস্ট রোগের কারণে লাভের মুখ দেখতে পারিনি। বোরো আবাদ করে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রস্তুতি নিয়েছি। গত বছরের চেয়ে বেশি দামে ধান বীজ কিনেছি। এবার শীতে বীজতলা নষ্ট হলে দ্বিতীয় দফা লোকসানের ঝুঁকি তৈরি হবে।

উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের চকপাড়া গ্রামের কৃষক সাদ্দাম খান বলেন, এক বিঘা জমিতে হাইব্রিড জাতের টমেটোর চারা লাগিয়েছি। গাছে ফুল আসতে শুরু করেছে। শীতের ফুল ঝরে যাচ্ছে।

শ্রীপুর পোল্ট্রি মালিক সমিতির সভাপতি এম এ মতিন বলেন, কয়েকদিনের শীতে মুরগির উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। মুরগি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ও অপুষ্টির সমস্যাও দেখা দিয়েছে।

ময়না ডেইরি ফার্মের স্বত্বাধিকারী আবদুল কাইয়ুম জানান, শীতে গবাদি পশুর রোগ বালাই বেড়ে গেছে। কমে গেছে দুধের উৎপাদন। কিছু গাভি অসুস্থ হয়ে গেছে।

শ্রীপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাক্তার এ কে এম আতিকুর রহমান বলেন, তীব্র শীতের মানুষের মতো পশু-পাখির অবস্থাও বিপর্যস্থ হয়েছে। শীতে পশু-পাখির রোগবালায় একটু বেশি দেখা দেয়। তবে দুধ ও ডিম উৎপাদনে কোনো প্রভাব পড়বে না। প্রতিটি খামারে এবং বাড়ি বাড়ি পশু-পাখির স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা জন্য সেবা দিয়ে যাচ্ছি।

শ্রীপুর উপজেলা কৃষি কৃষি কর্মকর্তা সুমাইয়া সুলতানা বলেন, শীত ও কুয়াশায় ফসলের যাতে কোনো ধরনের ক্ষতি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। পাতা ও ফুল ঝরে যাওয়া রোধ, সবজি ও ফসলের পোকা আক্রমণ ঠেকাতে কৃষককে নানা রকমের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

কুড়িগ্রামের চিলমারীতে তীব্র শীতে ইরি-বোরো আবাদের প্রভাব পড়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৯টায় জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দিনের অধিকাংশ সময় সূর্যের দেখা মিলছে না। চরাঞ্চলের মানুষ বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন। চিলমারী উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত, শীত নিবারণে উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে প্রায় ৪ হাজার ৫০ জন শীতার্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কম্বল বিতরণ করা হয়েছে।

নাটোরে মঙ্গলবার তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে। মাধ্যমিক, প্রাথমিক ও মাদরাসার পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানান, জেলার প্রাথমিক পর্যায়ের ১ হাজার ১৭৫টি এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল-মাদরাসা ৩৮৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সোমবার রাতে এক নোটিসের মাধ্যমে বন্ধের নির্দেশ দেন। মহসিন আলী নামের এক কৃষক জানান, সকালে মাঠে ঠান্ডায় কাজে যাওয়া যাচ্ছে না।

দুই সপ্তাহ পর মঙ্গলবার পঞ্চগড়ে সূর্যের ঝলমলে রোদের দেখা মিলেছে। পঞ্চগড় জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মো. শাহা আলম মিয়া জানান, জেলার কিছু খেতে কুয়াশা ও শীতের কারণে লেট ব্লাইড রোগ দেখা গেছে। এ ব্যাপারে চাষিদের প্রয়োজনীয় কৃষি পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গার আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক জাহিদুল হক জানান, এ মৌসুমে সোমবার পর্যন্ত জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি। মঙ্গলবার তা লাফিয়ে ৬ দশমিক ৬ ডিগ্রিতে নেমে আসে।

সদর উপজেলার হাজরাহাটি গ্রামের পানচাষী রকিব হোসেন বলেন, শীতে পান পাতা ঝরে যাচ্ছে। পান ছাড়াও এখন বোরো বীজতলার ক্ষতি হতে পারে।

সিরাজগঞ্জে তীব্র শীত থেকে বীজতলা রক্ষায় খেতে পলিথিন মুড়িয়ে রাখছেন কৃষকরা।

শাহজাদপুরের বাঘাবাড়ি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল বলেন, মঙ্গলবার সকাল ৯টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৬ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চলতি মৌসুমে এখানে এটি সর্বনিম্ন তাপমাত্রা।

অপরদিকে একই কারণে জেলার ১ হাজার ৬৭১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ রাখার তথ্য জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস. এম আবদুর রহমান।

প্রচন্ড শীত ও ঘনকুয়াশা উপেক্ষা করে কাক ডাকা ভোর হতে তালা উপজেলার বোরো ধানের চারারোপণ করছেন চাষিরা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভোর হতেই কৃষক ট্রাক্টর, কোদাল, মই ও মাথাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন মাঠে। উপজেলার চরকানাইদিয়া গ্রামের চাষি সবুর মোড়ল বলেন, প্রচন্ড শীত আর ঘন কুয়াশায় বোরো ধানের চারারোপণ শুরু করেছি। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হাজিরা খাতুন জানান, মাঠে মাঠে জোরেশোরে চলছে বোরো ধান রোপণের কাজ।

এ প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহাযোগিতা করেছেন কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী ও চিলমারী, গাজীপুরের শ্রীপুর, নাটোর, চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ ও সাতক্ষীরার তালা প্রতিনিধি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close