নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২০ জানুয়ারি, ২০২৪

গ্যাস সংকটে উদ্বেগ সমাধান অনুসন্ধানে

‘ভোর ৫টা বাজে উইঠা দেখি যে, একটু পানিও গরম করতে পারি না। সারা দিন তো গ্যাস আসেই না। সকাল বেলা নাশতা বানাইতে পারি না, ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। ছেলের বাবা ডায়াবেটিসের রোগী, তাকেও নাশতা বানিয়ে খায়াইতে পারি না। অনেক কষ্ট হয়’, কথাগুলো বলছিলেন বনশ্রীর গৃহিণী তমা রহমান। রান্নার গ্যাস ছাড়াও সিএনজি, শিল্পকারখানা এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রেও পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে দেশে চলছে তীব্র গ্যাস সংকট।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্যাস সংকটের কারণ নিজস্ব জ্বালানির উৎপাদন কমেছে আর আমদানিনির্ভরতা বেড়েছে। দেশে প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। পেট্রোবাংলার পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদ্যুৎ, শিল্প, সার গৃহস্থলি, সিএনজিসহ ৭টি সেক্টরে চাহিদা দাঁড়াবে ৩ হাজার ৭১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। পেট্রোবাংলার হিসাবেই বর্তমানে ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাসের ঘাটতি আছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম বলেন, দিন দিন আমাদের উৎপাদন কমে আসছে। উৎপাদন বাড়ানোর একটা চেষ্টা হয়েছিল, তাতে কিছু জায়গায় উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু অন্য জায়গায় কমে গিয়ে নিট উৎপাদন কমে গেছে। আমদানির ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাচ্ছি- একটা স্থবিরতা আছে। এ মুহূর্তে কোনো স্বল্পকালীন সমাধান নেই। এ জ্বালানি সংকট যেটা, সেটা ডলারের সংকট না কাটলে স্বল্পকালীন কোনো সমাধান নেই।

দেশে গ্যাস সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। পেট্রোবাংলার হিসাবে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাসের চাহিদাই হবে এবার দেড় হাজার মিলিয়ন ঘটফুটের মতো। তবে উৎপাদন সক্ষমতা অনুযায়ী গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সার্বিক চাহিদা হলো ২ হাজার ২৪০ এমএমসিএফডি। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা হচ্ছে ৭৫০-৮০০ এমএমসিএফডি গ্যাস। অর্থাৎ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় গ্যাসের যে চাহিদা রয়েছে, সেটির বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে ৪০ শতাংশের মতো।

অধ্যাপক তামিম বলেন, গত বছর তেল-গ্যাস-কয়লা সব মিলিয়ে ১৩-১৫ বিলিয়ন ডলার লেগেছে। এ বছর জ্বালানির দাম একই থাকলে প্রতি মাসে ১.২ বিলিয়ন ডলার লাগবে। অর্থাৎ এক বছরে ১৮ বিলিয়ন লাগতে পারে। এ বিষয়টি প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করবে। আমাদের তো শুধু জ্বালানি আমদানি করলেই হবে না। শিল্পকারখানা চালাতে গেলে কাঁচামাল টোটাল আমদানির যে চাপ, সেটা তো আছেই। সেখানে জ্বালানি অতিরিক্ত চাপ চলে এসেছে। কারণ আমাদের জ্বালানি পুরো পরিকল্পনাটাই আমদানিনির্ভর হয়েছে। সরকারি হিসাবে, এ বছর গরমে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা হতে পারে ১৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের মতো। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেল, গ্যাস ও বিপুল পরিমাণ কয়লা প্রয়োজন হবে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমদানিসহ জ্বালানির জন্য ব্যয় করতে হয়েছে ৬১ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা। অধ্যাপক তামিম বলেন, ‘বর্তমানে ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করতেই সরকার হিমশিম খাচ্ছে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনুযায়ী, জ্বালানি আমদানি ব্যয় মেটানো একটা বড় চ্যালেঞ্জ।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক ও গবেষক মাহা মির্জা বলেন, ‘আমদানিনির্ভর হওয়ায় পরিস্থিতি উদ্বেগের হয়েছে। আমাকে এটা পুরো ডলারে পরিশোধ করতে হচ্ছে এবং আপনারা জানেন, আমাদের ডলারের যে রিজার্ভ আমাদের, সেটা কমে আসছে খুবই আশঙ্কাজনকভাবে। এখনই কিন্তু আমি বিল পরিশোধ করতে পারছি না। আপনি দেখবেন বিভিন্ন প্রতিবেদনে বিপিসি পেট্রোবাংলা বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না জ্বালানির।’

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশে নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ না থাকা এবং আমদানিনির্ভরতা বৃদ্ধির কারণেই সংকটের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা হয়েছে, কিন্তু নিজস্ব কয়লা নিয়ে সিদ্ধান্তে আসা যায়নি। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম সমস্যার পেছনে প্রধানত বাংলাদেশে স্থলভাগ ও সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান তৎপরতায় ঘাটতি দেখেন। তিনি বলেন, সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ক্ষেত্রে ভারত ও মিয়ানমার ভালোভাবে করলেও বাংলাদেশের সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলন হয়নি, অনুসন্ধানও হয়নি। গ্যাসের সংকট সহসা কাটবে না।

মাহা মির্জা বলেন, ২০১৬ সালে সরকার যে মাস্টারপ্ল্যান করেছে, সেখানে পুরো জ্বালানি খাতটাকে সাজানো হয়েছে আমদানিনির্ভর করে। তাদের মাস্টারপ্ল্যানেই বলা ছিল, সৌর ও বায়ুবিদ্যুতের খরচ কমে আসবে আর কয়লা ও এলএনজির দাম বৃদ্ধি পাবে। এটা এমন না যে, এটা তাদের কাছে অজানা তথ্য। এলএনজি স্পট মার্কেট সবসময়ই একটা অনিশ্চিত বিষয়। যে আন্তরিকতা, দক্ষতা এবং যে প্যাশনের সঙ্গে তারা কয়লা এবং এলএনজি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো করেছে, সেই একই দক্ষতা একই প্যাশন দিয়ে যদি তারা নবায়নযোগ্য এবং দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান এবং উত্তোলন করতেন, তাহলে আমাদের আজকে এ সংকটের মধ্যে পড়তে হতো না।

সমাধান কীভাবে : এ মুহূর্তে দেশের ২২টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে দৈনিক উত্তোলন হচ্ছে কমবেশি ২ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস। আর ৫০০ এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। এলএনজি আমদানির সক্ষমতা অনুযায়ী দৈনিক সর্বোচ্চ ৮০০ থেকে ৯৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি সম্ভব। এখনকার চাহিদা পূরণে আমদানি করা ছাড়া কোনো উপায় নেই, তবে দীর্ঘ মেয়াদে সমাধানের জন্য সাগরে এবং স্থলভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, অনুসন্ধান বাড়ানোটাই হবে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের সর্বোত্তম উপায়। যথেষ্ট পরিমাণ অনুসন্ধান করতে হবে। কূপ খনন করে যেতে হবে। ১০টা কূপ খনন করে যদি ৩টায়ও পান তাহলেও কিন্তু ভালো। এ কাজটা না করলে এ গ্যাস সংকট থেকে কখনোই উত্তরণ ঘটাতে পারব না। স্থলভাগেও জরুরি ভিত্তিতে বাপেক্স এবং এর সঙ্গে বিদেশি কোম্পানিকে এনগেজ করতে হবে। সামগ্রিকভাবে আমাদের অনুসন্ধান কাজকে আরো জোরালো করতে হবে।

বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, জ্বালানি সংকট সমাধানের জন্য সরকার বহুমুখী জ্বালানি ব্যবহার করছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে জোর তৎপরতা আছে। এ বছরই সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হবে। এছাড়া পরিবেশ ও কৃষিজমি রক্ষা করে নিজস্ব কয়লা উত্তোলনের জন্যও পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে সরকার। এবার ৪৬টা কূপ খনন করব দুই বছরে। আরো ১০০ কূপ খনন করব ২০২৫ সালের মধ্যে। তাতে আমি আশাবাদী, দুই বছরের মধ্যে আমরা আরো ৫০০ মিলিয়ন যোগ করব। কিন্তু ডিমান্ড তো আরো বেশি। দেড় হাজার এমএমসিএফ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close