বিশেষ প্রতিবেদক
বিপদে ৭০ লাখ পরিবহন শ্রমিক
বিএনপি-জামায়াতের সরকারবিরোধী টানা রাজনৈতিক কর্মসূচির বেড়াজালে আটকে গেছে শ্রমজীবী মানুষের আয়, জীবিকায় লেগেছে টান। ফলে ঘরে বসে রোজগারহীন শ্রমিকরা সংসার চালাচ্ছেন ধারদেনা করে। বিশেষ করে সড়ক পরিবহন খাতের শ্রমিকরা বেশি বিপদে পড়েছেন। কারণ জ্বালাও পোড়াও কর্মসূচির কারণে দূরপাল্লার ৬০ শতাংশ বাসই চলছে না। অভ্যন্তরীণ রুটেও যাত্রী কম।
ঢাকার সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন রুটে দূরের বাসগুলো নিয়মিত চলাচল করছে না। বেশির ভাগ বাসের টায়ার, ব্রেকঅয়েল, বাকেট, গ্যাসকেট, বিয়ারিং, সিট, রংসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই বাস টার্মিনালে পরিবহন শ্রমিকরা জানান, আগুনের ভয়ে যাত্রী কমে গেছে। বাস চালাতে চাইলে কোনো দিনই অর্ধেক যাত্রীও মিলে না। অবরোধ ও হরতাল ছাড়া সপ্তাহের দুই দিন বা তিন দিন হয়ত বাস চালানো যায়।
কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া-ঢাকা রুটে মনোহরদী পরিবহনের বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। এই পরিবহনের একটি বাসের চালক জয়নাল মিয়া বলেন, ছয় সদস্যের সংসার এক মাস ধরে আর টানতে পারছি না। কোনো দিন হাঁড়িও চড়ছে না। মালিকরা আগুনের ভয়ে বাস ছাড়তে নিষেধ করেন। রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোয় সম্প্রতি গেলে চালক ও অন্যান্য পরিবহন শ্রমিকরা জানান, আগুনের ভয়ে যাত্রীও কমে গেছে। বাস চালাতে চাইলে কোনোদিনই অর্ধেক যাত্রীও মিলে না। অবরোধ ও হরতাল ছাড়া সপ্তাহের দুই দিন বা তিন দিন হয়ত বাস চালানো যায়।
মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালে দেখো গেছে, ভেতর ও বাইরের সড়কে দূরপাল্লার বাসগুলো সারিবদ্ধভাবে পার্কিং করা। অধিকাংশ বাসের দরজা, জানালা লাগানো। এর মধ্যে একটি বাসের নিচে বিছানা পেতে শুয়ে আছেন এনা পরিবহনের শ্রমিক মাজিদুল ইসলাম। কিন্তু গরম, ধুলাবালি আর চারপাশের যানবাহনের শব্দে কিছুতেই ঘুমাতে পারছিলেন না তিনি।
একটু এগিয়ে গিয়ে মাজিদুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি এনা পরিবহনের একটি বাসের সুপারভাইজার। আলাপকালে মাজিদুল জানান, তিনি যে বাসে যাত্রী পরিবহন করেন, সেটি ঢাকা-রংপুর রুটে যাতায়াত করে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের অবরোধ কর্মসূচির কারণে যাত্রী সংকট। তাই গত দুদিন ধরে তিনি বাসের ভেতরেই ঘুমান। তবে দিনের বেলা রোদের তাপমাত্রা বেশি থাকায় তিনি বিছানা পাতেন বাসের নিচে।
হরতাল-অবরোধে পারিশ্রমিক সম্পর্কে জানতে চাইলে মাজিদুল ইসলাম বলেন, সাধারণত পরিবহন শ্রমিকরা দিনের বেতন দিনেই পান। যেদিন কাজ করবে না, সেদিন বেতনও পাবে না। আর হরতাল-অবরোধে অঘোষিতভাবে পরিবহন শ্রমিকদের বেতন বন্ধ থাকে। শুধু খোরাকি (খাবার) বাবদ দিনে ১০০ টাকা করে দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে হোটেলে দুবেলা ভাত খেতে গেলে কম করে হলেও ২০০ টাকা লাগে। গাড়ি বন্ধ থাকলে সংসার চালানো খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। খোরাকি ভাতা নিয়ে পরিবহন শ্রমিকদের কোনো আক্ষেপ নেই। হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি না দিলেই তারা খুশি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বিএনপি-জামায়াতের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বেশি আগুন লাগানো হয়েছে বাস ও ট্রাকে। এছাড়া দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকছে বিভিন্ন রুটে। পরিবহন না চলাতে পারায় ক্ষতি হয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা।
চালকদের অবস্থা খুবই খারাপ উল্লেখ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, ৭০ লাখ পরিবহন শ্রমিক সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন। সপ্তাহের বেশিরভাগ সময় দূরের গাড়ি বন্ধ থাকছে। চলাচল করছে বড় জোড় ৪০ শতাংশ বাস। এখন বছরের শেষে পরিবহন শ্রমিকরা অর্থ সংকটে সংসারের ঘানি টানতে পারছে না। তারা স্কুলে ছেলেমেয়ের ফিস দিতে পারেছে না।
রাজধানীর অটোরিকশা চালক সবুজ মিয়া বলেন, অবরোধের আগের দিন থেকে রাস্তায় গাড়ি নিয়ে নামি না। কারণ ফেনীতে কয়েক দিন আগে অটেরিকশা পুড়ানো হয়েছে। সপ্তাহে তিন দিন রাস্তায় নামতে পারছি। কিন্তু অনেক দিন যাত্রীর অভাবে মালিককে জমাই দিতে পারি না। ফলে সংসার চালাতে গিয়ে কষ্ট হচ্ছে।
বাংলাদেশ অটোরিকশা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফ খোকন বলেন, সারা দেশে অটোরিকশা কমপক্ষে পাঁচ লাখ। এসব হালকা যানবাহনে চালক আছেন ৮ লাখ। প্রতি চালকের দৈনিক আয় হাজার টাকা করে ধরলে তাদের দৈনিক আয় হয়ে থাকে ৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে ৬০ হাজার অটোরিকশা চালক আছেন। তাদের দৈনিক আয় গড়ে ১০০০ টাকা । তাতে ঢাকায় চালকদের দৈনিক আয় ছয় কোটি টাকা। হরতাল অবরোধ পরিস্থিতি শুরুর পর থেকে চালকদের অনেকেই ভয়ে রাস্তায় বের হচ্ছেন না। আবার গাড়ি নিয়ে বের হলে কয়েকটি ট্রিপ দেওয়ার পর মালিককে দৈনিক জমাও দিতে পারছেন না। মালিকরা গাড়ি বের করলেই ১২০০ টাকা নিতে চাপ দেন। কিন্তু বেশিরভাগই মালিককে তা দিতে পারছেন না। ফলে অটোরিকশার চালকরা এখন মহাবিপদে আছেন। তারাও ধারদেনা করছেন।
সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের দাবি, পরে তফসিল বাতিলের প্রতিবাদে বিএনপি-জামায়াত এবং সমমনা দলগুলো এক মাসের বেশি সময় আন্দোলন করে আসছে। অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি এক মাস পূর্ণ হয় গত ২৯ নভেম্বর।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকায় গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষের পর থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২৬৮টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, গত ৬ ডিসেম্বর সকাল ৬টা থেকে গতকাল ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুর্বৃত্তরা ১৪টি যানবাহনে আগুন লাগায়। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে ৭টি, গাজীপুরে ২টি, চট্টগ্রামে ৪টি ও সিরাজগঞ্জে একটি যানবাহনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
"