reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৩

দুবাইয়ে জলবায়ু সম্মেলন

তহবিলের ন্যায্য বণ্টন চায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশ

জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্ষতির প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। কার্বন নিঃসরণের পাশাপাশি এবার প্রথমবারের মতো স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে পৃথক তহবিল গঠন করা হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের এক্সপো-২০২০ সিটিতে চলমান জলবায়ু সম্মেলনে (কপ২৮) বৈশি^ক উষ্ণায়নের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় তহবিল গঠনের অঙ্গীকার করেছেন বিশ্বনেতারা। জাতিসংঘ আয়োজিত এই সম্মেলনে অংশ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো জলবায়ু তহবিলের ন্যায্য বণ্টনের দাবি জানিয়েছে। সম্মেলনের প্রথম দিন থেকে শুরু করে ষষ্ঠ দিনেও গুরুত্ব পেয়েছে তহবিলের বিষয়টি। কারণ পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও আগাম কিংবা বিলম্বে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, ভূমিকম্প, নদীভাঙন, জলাবদ্ধতা, উপকূলীয় ফসলি জমিতে লবণাক্ততা এক দশকে বহুলাংশে বেড়েছে। এই পরিবর্তন ঠেকাতে জলবায়ু সুরক্ষায় পাঁচ দফা লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করছেন পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। তবে এর বিরুদ্ধে নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন উন্নত দেশগুলোর প্রতিনিধিরা। এ নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরে এবারের জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে (কপ২৮) পাল্টাপাল্টি বিতর্ক শুরু হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার এ জলবায়ু সম্মেলনে জোরালো বিতর্ক হয়। পাঁচ দফা লক্ষ্য বিষয়ে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এ সম্মেলনে বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন।

আলোচকরা শুরুতেই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির সার্বিক চিত্র নির্ণয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এ দিন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশ নেন। আলোচনায় থাকা পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে রয়েছে অভিযোজন, কার্বন নিঃসরণ কমানো, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং ক্ষতি মোকাবিলায় অর্থায়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও সক্ষমতা বৃদ্ধি।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শেষ মুহূর্তে কপ২৮ এ যোগদানের পরিকল্পনা বাতিল করায় সম্মেলনের সফলতা নিয়ে যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছিল, দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের এক ঘোষণায় নতুন আশার সঞ্চার করেছে। ১৩ দিনের এ সম্মেলনের গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের জন্য ৩০০ কোটি ডলার অনুদান ঘোষণা করেন, যা এ যাবৎকালে এই খাতে সবচেয়ে বড় অনুদান।

এদিন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ছাড়াও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সম্মেলনে আলো ছড়িয়েছেন। কপ২৮-এর সভাপতি ড. সুলতান আল জাবের বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য জ্বালানির সক্ষমতা বৃদ্ধির অঙ্গীকার ঘোষণা করেন। বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের ঘোষণায় গতকাল পর্যন্ত ১১৭টি দেশ অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। সুলতান আল জাবের একই সঙ্গে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামানোরও আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, দুবাই জলবায়ু সম্মেলন শুরুই হয়েছে ‘তহবিল’ বার্তা দিয়ে। তহবিল অবশ্যই জরুরি কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বহু গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার ও দাবি তহবিলের আড়ালে চাপা পড়ে যেতে পারে। জলবায়ু প্রশ্নে এখন পৃথিবীর মানুষ ন্যায্যতার দাবি তুলেছে। তবে সম্মেলনের শুরু থেকে প্রতিদিনই জলবায়ু অর্থায়নের সারিতে যোগ হচ্ছে নতুন দেশ। আর এসব অর্থায়নের বেশির ভাগই আবার বিনিয়োগ হিসেবে দেওয়ার প্রস্তাবও রয়েছে। অথচ বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর দাবি ন্যায্যতার ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিতে সম্মত হয়েছে ১১৮টি রাষ্ট্র। এদিকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে সক্রিয় দাবি তুলবে বলে জানা গেছে। বৈশ্বিক স্টকটেক, ক্ষয়ক্ষতি তহবিল, অভিযোজন লক্ষ্যমাত্রা, জলবায়ু অর্থায়ন এবং অভিযোজন তহবিল বাড়ানোর বিষয়গুলো অগ্রাধিকার দেবে বাংলাদেশ।

জলবায়ু সম্মেলনে দূষণ মোকাবিলায় পারমাণবিক শক্তির তিনগুণ বৃদ্ধি চেয়ে একটি ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছে ২০টিরও বেশি দেশ। ২০২০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে পরিবেশে কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমনের পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনার প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে পারমাণবিক শক্তি বৃদ্ধি চায় তারা।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে ঘানা, জাপান ও ইউরোপের দেশগুলো ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছে। এ ছাড়া স্বাক্ষরকারী অন্যান্য দেশের মধ্যে আছে যুক্তরাজ্য, বুলগেরিয়া, কানাডা, চেক প্রজাতন্ত্র, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, দক্ষিণ কোরিয়া, মলদোভা, মঙ্গোলিয়া, মরক্কো, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, সুইডেন, ইউক্রেন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।

কার্বনের পরিমাণ কমানোর লক্ষ্যে পারমাণবিক শক্তি একটি মূল ভূমিক পালন করে বলে মনে করছে কপ-২৮ সম্মেলনে অংশ নেওয়া দেশগুলো। সম্মেলনে মার্কিন জলবায়ুবিষয়ক রাষ্ট্রদূত জন কেরি বলেন, শক্তির অন্যান্য সব উৎসের চেয়ে এটি অন্যতম বিকল্প হতে চলেছে। তবে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার ছাড়া ২০৫০ সালের মধ্যে পরিবেশে কার্বনের পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনাও সম্ভব নয়। এটি বিজ্ঞানভিত্তিক বাস্তবতা, এতে কোনো রাজনীতি বা মতাদর্শ জড়িত নয়।

জলবায়ুবিষয়ক গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, গত ২৭টি সম্মেলনে বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানরা সম্মত হয়েছেন যে ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের খাদ্যব্যবস্থা, বাসস্থান, চিকিৎসার ব্যয় বেড়েছে। অথচ ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলো সে তুলনায় কোনো ধরনের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ দেখতে পায়নি। প্রতিটি সম্মেলনেই শুধু কথার পিঠে কথা থাকে। সম্মেলন শেষে আরেকটি নতুন সম্মেলনের অপেক্ষায় থাকতে হয় কীভাবে এই একটি পৃথিবীকে আমরা আরো বেশি বাসযোগ্য করে তুলতে পারব।

সম্মেলনে যোগ দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর পরিবেশবিষয়ক বিশেষ দূত সাবের হোসেন চৌধুরী প্রতিদিনের সংবাদেকে বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে এখানে যে শুনানি হচ্ছে তা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় কোনোভাবেই তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির ওপর উঠে গেলে তা আমাদের সবার জন্যই ক্ষতিরকারণ। জাতিসংঘের মহাসচিব ২০৩০ সালের মধ্যে সব উন্নত দেশকে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে সরে আসতে বলেছেন। আমাদের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে এই সময়সীমা বাড়তি থাকবে। তবে কী কী উপায়ে আমরা এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধে একসঙ্গে কাজ করতে পারি তা নিয়েও এই কপে আলোচনা হবে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে জলবায়ু অভিঘাত মোকাবিলায় ক্রমবর্ধমান ব্যয়বৃদ্ধি মেটাতে একটি সমন্বিত সর্বজনীন অন্তর্ভুক্তিমূলক আন্তর্জাতিক অর্থায়ন ব্যবস্থা প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং কপ২৮ বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের প্রধান ড. হাছান মাহমুদ। কপ২৮ সম্মেলনের সাইডলাইনে ‘রাইজিং উইথ দ্য টাইড : ট্র্যাকিং রিফর্মস ইন ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্সিয়াল আর্কিটেকচার ফর এক্সিলারেটেড ডেভেলপমেন্ট-পজিটিভ ক্লাইমেট অ্যাকশন’ শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় পৃথিবী গ্রহটিকে মানুষের বাসযোগ্যভাবে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তিনি এ আহ্বান জানান।

ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক ও কপ২৮ কোয়ালিশনের সদস্য শরীফ জামিল প্রতিদিনের সংবাদেক বলেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা এরই মধ্যে ১ দশমিক ৪ ডিগ্রিতে চলে এসেছে। পৃথিবীকে বাঁচাতে গেলে এটা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখতে হবে। এই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সেটিকে আর কমানো যাবে না। সেসব দেশ নীতিকথা বলছে, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের কথা বলছে তারাই জীবাশ্ম জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ করছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে জিততে হলে আমাদের বিশ্বের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close